ইসমাইল আলী: ১০ মিনিটে ধোয়া যাবে ১৪ কোচের একটি ট্রেন। শ্রমিক লাগবে মাত্র একজন, যিনি যন্ত্র পরিচালনা করবেন। অথচ বর্তমানে একেকটি ট্রেন ধোয়ায় ২০ থেকে ২৫ শ্রমিক লাগে। ফলে নতুন প্লান্ট স্থাপনের ফলে জনবল ব্যয় কমবে। সাশ্রয় হবে পানি, আর ধোয়ার পরে চকচক করবে ট্রেন। এসব গুণের কথা বলেই ৩৬ কোটি টাকায় দুটি স্বয়ংক্রিয় ওয়াশিং প্লান্ট কিনেছিল রেলওয়ে। যদিও বাস্তবে এগুলো তেমন কোনো কাজেই লাগছে না।
ওয়াশিং প্লান্ট দুটির মধ্যে একটি বসানো হয়েছে কমলাপুর স্টেশনে, অন্যটি রাজশাহীতে। গত ৮ নভেম্বর এই প্লান্ট উদ্বোধন করেন রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম। তবে দিনে একটি বা দুটি ট্রেনের সর্বোচ্চ ৪০টি কোচ ধোয়া হয় এসব প্লান্টে। এ ধরনের নামমাত্র ব্যবহারের পরও দেশের সব স্টেশনে স্বয়ংক্রিয় ওয়াশিং প্লান্ট বসানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
ওয়াশিং প্লান্টগুলোর কার্যকারিতা যাচাইয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি এ সুপারিশ করে। সম্প্রতি রেলপথ মন্ত্রণালয়ে এ প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়। এছাড়া তদন্ত প্রতিবেদনে ওয়াশিং প্লান্টগুলো বেশ কার্যকর বলেই দাবি করা হয়।
প্রসঙ্গত, গত বছর ৮ নভেম্বর উদ্বোধনের পর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ওয়াশিং প্লান্টগুলোর কার্যকারিতা ও নামমাত্র ব্যবহার নিয়ে নানা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে এগুলোর কার্যকারিতা যাচাইয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটি সম্প্রতি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, ওয়াশিং প্লান্টগুলো কোচ ধোয়ায় খুবই কার্যকর। তবে এগুলোর অধিকতর ব্যবহারের জন্য প্লান্ট পর্যন্ত বগিগুলো নিয়ে যেতে একটি করে অতিরিক্ত লুপ লাইন নির্মাণ করতে হবে। এছাড়া প্লান্টগুলো কেনার প্রকল্পের আওতায় ২৪ জন শ্রমিককে বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনা হয়েছে। তাদের দ্বারা প্রতি মাসে অন্তত দুজন করে শ্রমিককে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্লান্টগুলোর ওয়ারেন্টি রয়েছে দুই বছর। তাই এ সময় প্লান্টগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর ন্যস্ত করতে হবে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বর্তমানে স্থাপিত ট্রেন ওয়াশিং প্লান্টগুলো শুধু বগির বাইরের দিকটা পরিষ্কার করতে সক্ষম। এতে বগিগুলোর ভেতরটা শ্রমিকদের দ্বারা পরিষ্কার করতে হয়। ফলে শ্রমিক ব্যবহার কমানো সম্ভব হচ্ছে না। তাই আগামীতে ট্রেনের ভেতরে ও বাইরে উভয় দিক পরিষ্কার করা যায় এমন স্বয়ংক্রিয় ওয়াশিং প্লান্ট স্থাপনের সুপারিশ করা হয়। পাশাপাশি সারাদেশের সব স্টেশনে স্বয়ংক্রিয় ট্রেন ওয়াশিং প্লান্ট স্থাপনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশও করা হয়।
জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বয়ংক্রিয় ট্রেন ওয়াশিং প্লান্ট রয়েছে। এটি রেলওয়ের জন্যও খুবই জরুরি। কারণ এখন ট্রেন বাড়ছে, ট্রিপ বাড়ছে, ফলে বগির ব্যবহার বাড়ছে। এগুলো দ্রুত ধোয়ার জন্য স্বয়ংক্রিয় ট্রেন ওয়াশিং প্লান্ট দরকার। তবে শুধু দুটি স্টেশনে ওয়াশিং প্লান্ট স্থাপন করলেই হবে না, বরং পর্যায়ক্রমে দেশের বড় ও গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনগুলোয় এ প্লান্ট স্থাপন করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
এদিকে সরেজমিনে দেখে ও রেলওয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কমলাপুরের প্লান্টটিতে এখন সারা দিনে দুই থেকে তিনটি ট্রেনের ৪০ থেকে ৫০টি কোচ ধোয়া হয়। বাকিগুলো পুরোনো পদ্ধতিতেই পরিষ্কার করেন শ্রমিকেরা। স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র চালু হলে শ্রমিক কম লাগবে, জনবলের পেছনে ব্যয় কমবেÑএই দাবিও যথাযথ নয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, আগের মতো সংখ্যায় শ্রমিক দিয়ে ট্রেন ধোয়ার কাজ করতে হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের পরিচালক ফকির মো. মহিউদ্দিন বলেন, যন্ত্রে এখন পর্যন্ত কোনো সমস্যা নেই। তবে ব্যবহারের সুবিধার অভাব রয়েছে। এটা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। এজন্য বেশি ট্রেন ধোয়া যাচ্ছে না।
রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবকাঠামোগতভাবে ভুল জায়গায় বসেছে ওয়াশিং প্লান্ট। তাই মিলছে না সুফল। এখন প্ল্যাটফরম থেকে তিনবার ইঞ্জিন পরিবর্তন এবং তিন স্থানে কোচ থামিয়ে নেয়া হয় ওয়াশিং প্লান্টে। এতে ভোগান্তি বেড়েছে দ্বিগুণ। তাই প্লান্টটিতে দিনে দুই থেকে তিনটি ট্রেন ধোয়া হয়। বাকিগুলো পুরোনো পদ্ধতিতেই পরিষ্কার করেন শ্রমিকেরা।
তদন্ত কমিটির সদস্য এ প্রসঙ্গে বলেন, মূলত এ জটিলতা এড়াতেই নতুন একটি লুপ লাইন নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে। এটি নির্মাণ করা হলে সরাসরি লাইন থেকে প্লান্টে ট্রেন নেয়া যাবে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেছিলেন, আগে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে হাত ও ব্রাশ দিয়ে ঘষে ট্রেনের ভেতর ও বাইরের অংশ পরিষ্কার করা হতো। এতে বগি ঠিকমতো পরিষ্কার হতো না। বিভিন্ন অংশে কালো দাগ পড়ত। এখন আধুনিক পদ্ধতিতে প্লান্টে ট্রেন ঢুকলেই জানালা-দরজা লাগিয়ে ওয়াশিং পাউডার ও পানি দিয়ে অটোমেটিক পদ্ধতিতে পরিষ্কার হয়ে আরেক দিক দিয়ে বেরিয়ে আসবে। এতে ট্রেন ঝকঝকে দেখাবে। এছাড়া এ প্লান্ট প্রতিদিন কমপক্ষে এক লাখ লিটার পানি সাশ্রয় করবে। আর ব্যবহƒত পানির ৭০ শতাংশই রি-সাইকেল করে আবার ব্যবহার উপযোগী করা সম্ভব হবে। যদিও বাস্তবে তেমনটি হচ্ছে না।
যদিও রেলের শ্রমিকেরা বলছেন, সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হলো, যন্ত্রে ট্রেন ধোয়ার পরও পানের পিক, চুইংগামসহ কোচের গায়ে লেগে থাকা অন্যান্য দাগ ব্রাশ দিয়ে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করতে হয়। ট্রেনের ভেতর ও শৌচাগারে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করতে হয় পুরোনো পদ্ধতিতেই। সব মিলিয়ে রেলওয়ের ব্যয় কমেনি, বরং স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র চালাতে গিয়ে বিদ্যুৎ বাবদ খরচ বেশি হচ্ছে।
সূত্র:শেয়ার বিজ