শিরোনাম

কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস: এ কেমন প্রতারণা

কুড়িগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন

।। রেল নিউজ ।।
‘এক দিনও কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস ঠিক সময়ে পাইনি’—সম্প্রতি ঢাকা বিমানবন্দর রেলস্টেশনে অনেকের সঙ্গে কথা বলে অভিন্ন এ মন্তব্য পাওয়া যায়। রেলের কয়েকজন কর্মচারীর সঙ্গে কথা হলো। তাঁদেরও মন্তব্য একই। এই বিলম্ব কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত গড়ায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। বিমানবন্দর রেলস্টেশনেরও কেউ জানেন না কখন আসবে ট্রেন।

কী আশ্চর্যজনক প্রতারণা! কুড়িগ্রাম থেকে ছাড়ার সময় কখনো কখনো ট্রেন যথাসময়ে ছাড়ে। রংপুর ও লালমনিরহাট এক্সপ্রেসের ক্ষেত্রেও সময় মেনে চলার রেকর্ড কম। রংপুর-কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাটগামী তিনটি ট্রেনের প্রতি সীমাহীন অবহেলা আছে। এসব ট্রেনের আগে অন্য রুটের অনেক ট্রেন চলে যায়। এমনকি লোকাল ট্রেনও যথাসময়ে ছেড়ে যায়। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা এসব ট্রেনের যাত্রীদের অপেক্ষা করতে হয়।

বিমানবন্দর স্টেশনে হাজার হাজার যাত্রী দাঁড়িয়ে থাকেন। সামান্য কিছু বসার ব্যবস্থা, যা যাত্রীর তুলনায় অপ্রতুল। ট্রেনের সময় জানার জন্য যে নম্বর দেওয়া হয়েছে, সে নম্বরে এসএমএস দিয়েও জানা যায় না; বরং প্রতারণামূলক জবাব আসে। কতক্ষণ বিলম্ব হবে, এর সঠিক খবর জানায় না। একটি করে এসএমএস বাবদ কেটে রাখে ৫ টাকা ৩৩ পয়সা। এক এসএমএসে এত টাকা নেওয়া ডিজিটাল ডাকাতির সমান বলেই মনে হয়। যেখানে ট্রেন বিলম্ব হলে রেল কর্তৃপক্ষের আগাম জানানো নৈতিক দায়িত্ব, সেখানে ৫ টাকা ৩৩ পয়সা লাগে একবার খবর নিতে। তারও জবাব অধিকাংশ সময় প্রতারণামূলক।

১৬ অক্টোবর কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসের তিন বছর পূর্ণ হয়। সেদিন আমি সপরিবার ঢাকা থেকে রংপুর ফিরেছি। সেদিনও যথাসময়ে ট্রেন আসেনি। আমরা বিমানবন্দর রেলস্টেশনে বসে থাকতে থাকতে অন্তত ২০টি ট্রেন যাওয়া–আসা করল। কিন্তু কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসের খবর নেই। এসএমএস করলাম। জানা গেল, আনুমানিক ১০ মিনিট বিলম্ব হতে পারে। ভাবলাম ১০ মিনিট কোনো ব্যাপার না। ১০ মিনিট যায়, ২০ মিনিট যায়—এভাবে আড়াই ঘণ্টা চলে গেল। যতবার এসএমএস করেছি, কোনোবারই সঠিক বার্তা দেয়নি। যে ট্রেন ছাড়তে আড়াই ঘণ্টা বিলম্ব, সেই ট্রেনের যথাসময় যদি এসএমএসে বলত, তাহলে আমরা সেভাবেই অপেক্ষা করতাম। ১০টি এসএমএসের ৫৩ টাকাও অতিরিক্ত ব্যয় হতো না। কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস যখন চলে যায়, তখনো লালমনিরহাট এক্সপ্রেস আসেনি।

রেল খাতে অনেক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হয়েছে, এখনো হচ্ছে। দেশের অনেক রেলপথে এখন তুলনামূলক ভালো সেবা দেখা যায়। কিন্তু রংপুর-কুড়িগ্রামের রেলপথে এখনো ‘কালো বিড়ালের’ পদধ্বনি শোনা যায়।

কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস কুড়িগ্রাম থেকে ছাড়ে। ট্রেনটি যদি চিলমারী থেকে ছাড়ত, তাহলে চিলমারী ও উলিপুরের যাত্রীরাও এই সেবা সহজে পেতেন। জনগণের তুমুল দাবি থাকা সত্ত্বেও চিলমারী থেকে ছাড়ার কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। নামে কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস হলেও এই ট্রেন কেবল ছাড়ে কুড়িগ্রাম থেকে। কুড়িগ্রাম জেলার আর কোনো স্টেশনে এই ট্রেনের বিরতি নেই। কুড়িগ্রাম স্টেশনের পর টগরাইহাট, তারপর রাজারহাট স্টেশন। দীর্ঘদিন থেকে রাজারহাটের মানুষ দাবি করে আসছেন রাজারহাটে ট্রেনটির বিরতি চেয়ে। কিন্তু দিচ্ছে না। রাজারহাটবাসীর দাবি, রাজারহাটে ট্রেনটি বিরতি থাকলে দূরদূরান্তের যাত্রীরা এসে সেখানে ট্রেনে উঠতে পারতেন। উলিপুর উপজেলার থেতরাইসহ তিস্তার চরাঞ্চলের জনগণ এই সেবা পেতেন। অন্যদিকে ছিনাই ইউনিয়নের ধরলার চরের মানুষও রাজারহাটে এসে সহজে ট্রেনে উঠতে পারতেন। লালমনিরহাট এক্সপ্রেস যদি বুড়িমারী পর্যন্ত চলত, তাহলে বুড়িমারী স্থলবন্দরের যাত্রীরা এর সেবা পেতেন।

কুড়িগ্রাম থেকে কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস ছাড়ে সকাল ৭টা ১৫ মিনিটে। রংপুরের ওপর দিয়ে ঢাকা যায়। ট্রেনটি যদি চিলমারী থেকে ছাড়ত, তাহলে কুড়িগ্রামের প্রচুর যাত্রী সকালে রংপুরে এসে অফিস করতে পারত। এমনকি বাংলাদেশের ২০০ গুণ বৈষম্যের শিকার রাজীবপুর উপজেলার মানুষও কিছুটা সুবিধা পেতেন। বর্তমানে কেবল কুড়িগ্রাম শহরের যাত্রীরা চাইলে সহজে রংপুরে ওই ট্রেনে আসতে পারে। কুড়িগ্রাম জেলার রমনা, বালাবাড়ি, উলিপুর, পাঁচপীর, টগরাইহাট, রাজারহাট ও সিঙ্গারডাবরি স্টেশনের যাত্রীরা এই সুবিধা পান না। কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস চিলমারী থেকে ছাড়ার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে রাজারহাটে বিরতিও জরুরি। কেবল যুক্তিহীন দূরত্বের কথা বলে বিরতি না দেওয়ার কোনো মানে হয় না। রাজারহাট স্টেশনটির সংস্কারও অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসে কুড়িগ্রামের জন্য মাত্র ১০০টি আসন নির্ধারিত। এই আসনগুলোর জন্য যেসব টিকিট অনলাইনে দেওয়া থাকে, তারও অনেক টিকিট কুড়িগ্রামের পরের অনেক স্টেশনের যাত্রীরা কিনে থাকেন। এ কারণে নামেই কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসে পরিণত হয়েছে এ ট্রেন।

দেশে রেল যোগাযোগব্যবস্থার অনেক উন্নতি হলেও বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন স্থাপিত হয়নি। বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ না থাকায় রংপুর বিভাগের যাত্রীদের ঢাকা যাওয়ার জন্য জয়পুরহাট-নাটোর-পাবনা ঘুরে ঢাকা যেতে হয়। বাড়তি টাকা দিয়ে মানুষ সুবিধা কিনলেও রংপুর বিভাগের যাত্রীদের টাকাও বেশি গুনতে হয়, বিনিময়ে বিড়ম্বনা কেনা হয়। যুগ যুগ ধরে শুনে আসছি, বগুড়া-সিরাজগঞ্জ একটি রেললাইন হবে। সেই যুগের আর অবসান হয় না।

১৯৯২-৯৩ সালের দিকে ‘কাঞ্চন মেইল’ নামে একটি ট্রেন চিলমারী-পার্বতীপুর রুটে চলাচল করত। ট্রেনটির খুব সুনাম ছিল। ট্রেনটি সময় মেপে চলত। যাত্রীও প্রচুর হতো। এরপর কোনো কারণ ছাড়াই ট্রেনটি বন্ধ করে দেওয়া হলো। আরেকটি ট্রেন বিকেলে লালমনিরহাট-চিলমারী রুটে চলত। রাতে চিলমারী থেকে ফিরত। সেই ট্রেন এখন আর চলে না। পার্বতীপুরে সকালে ছেড়ে একটি ট্রেন চিলমারী যেত। আবার বিকেলে ফিরে আসত পার্বতীপুরে। সেই ট্রেন করোনার সময় বন্ধ হয়, আর চালু হয়নি। যখন ট্রেনের চাহিদা অনেক বেড়েছে, তখন এসব পথের ট্রেন সংখ্যা কমানো হয়েছে।

বর্তমানে একটিমাত্র কমিউটার ট্রেন রাত ৯টা-১১টায় কাউনিয়া থেকে চিলমারী যায়। ট্রেনটি সকালে রংপুরে আসে। রাতে যে সময় ট্রেনটি যায়, ওই সময় যাত্রী পাওয়া যায় না। এরপরও কেন ওই সময় যায়, তা বোধগম্য নয়। নব্বইয়ের দশকে যেখানে তিনটি ট্রেন চিলমারী যেত, সেখানে ৩০ বছর পরে ওই চিলমারীতে ট্রেন চলে মাত্র একটি। ওই ট্রেন সকালে রংপুরে যায়।

দেশজুড়ে নতুন নতুন রেললাইন স্থাপিত হয়েছে। পুরোনো রেলপথে ট্রেনের সংখ্যা বেড়েছে। সেসব বিবেচনায় নিলে রংপুর-কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাট-গাইবান্ধায় রেলসেবা তেমন বাড়েনি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস উঠেছে বাংলাদেশের সবচেয়ে গরিব পাঁচটি জেলার মধ্যে এই চারটির মানুষের। এই চার জেলার মানুষের কথা বিবেচনায় নিয়ে রেলসেবার মান বৃদ্ধি করা হোক। একই সঙ্গে বৃদ্ধি করা হোক এসব পথের ট্রেনের সংখ্যা।

তুহিন ওয়াদুদ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক

সূত্রঃ প্রথমআলো


Comments are closed.