হামিদ-উজ-জামান : অবশেষে সাপোর্ট স্টাফদের অবিশ্বাস্য বেতন প্রস্তাব থেকে পিছু হটেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ক্লিনারের বেতন ধরা হয়েছিল মাসে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা। এখন সেটি কমে দাঁড়াচ্ছে ২১ হাজার ১৩২ টাকায়। এ রকম অন্যান্য ক্ষেত্রেও ব্যয় কমে এসেছে।
পরিকল্পনা কমিশনে অবিশ্বাস্য বেতন প্রস্তাব ধরা পড়ার পর ভুল হয়েছিল জানিয়েছিল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু যারা এই ভুল করেছে তাদের বিরুদ্ধে নেয়া হয়নি দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা। তবে রেল সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন দাবি করেছেন, তিনি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে রেলওয়ের মহাপরিচালককে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কিনা সেটি জানাতে পারেননি তিনি। তিনি বলেন, ‘কোনো কোনো কর্মকর্তাকে সম্ভবত বদলি করা হয়েছে।’
সম্প্রতি প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) সংশোধন করে পাঠানো হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। এ পরিপ্রেক্ষিতে এর আগে স্থগিত প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা আগামী ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে।
রোববার রেল সচিব যুগান্তরকে বলেন, ‘এ ধরনের ভুল করা খুবই খারাপ কাজ। যারা একবার এমন ভুল করেন তারা ভবিষ্যতে আরও বড় ভুল করতে পারেন। তাই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছি। বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. শামসুজ্জামান বলেন, ‘এ রকম ভুল কি কেউ ইচ্ছে করে করে? ইচ্ছে করে হয়নি। তবে দায়ী কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। কতজনকে বদলি করেছেন? জানতে চাইলে তিনি জানান, একজনকে বদলি করা হয়েছে।’
অর্থনীতিবিদ ও বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘বদলি আর শাস্তিকে এক করে দেখার যুক্তি কি?। বদলি তো স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়ও হয়। প্রমোশন পেলেও তো হয়। এক্ষেত্রে দেখতে হবে বদলিটা পুরস্কার না তিরস্কার হিসেবে দেয়া হয়েছে। তাছাড়া শাস্তি কিনা সেটি বুঝতে হলে কোন জায়গা থেকে কোথায় বদলি করা হয়েছে সেটি দেখতে হবে। সেই সঙ্গে ঘটনাটি তদন্ত করে দেখা উচিত ছিল। যাকে বদলি করা হয়েছে তিনি প্রকৃত দোষী কিনা সেটিও প্রশ্ন থেকে যায়।’
রেলওয়ের সংশোধিত ডিপিপি সূত্রে জানা যায়, ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রস্তুতিমূলক কারিগরি সহায়তা’ প্রকল্পের প্রস্তাবে অফিস সহায়কের বেতন ধরা হয় প্রতি মাসে ৮৩ হাজার ৯৫০ টাকা। এখন সেটি কমিয়ে ধরা হচ্ছে ২১ হাজার ১৩২ টাকা। এছাড়া ক্যাড অপারেটরের বেতন ধরা হয় ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। সেটি কমিয়ে ধরা হচ্ছে ৭০ হাজার টাকা। ফটোকপি অপারেটরের বেতন প্রস্তাব করা ছিল ৮৩ হাজার ৯৫০ টাকা, এখন ধরা হচ্ছে ২১ হাজার ১৩২ টাকা। কম্পিউটার অপারেটরের বেতন ৮৩ হাজার ৯৫০ টাকা থেকে কমিয়ে ধরা হচ্ছে ৪০ হাজার টাকা এবং ফিল্ড কো-অর্ডিনেটরের বেতন প্রতি মাসে ৮৩ হাজার ৯৫০ টাকা থেকে কমিয়ে ৪০ হাজার টাকা করা হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক পরামর্শকের বেতন ১৬ লাখ টাকা থেকে ২৫ লাখ টাকার মধ্যেই রাখা হয়েছে। পরামর্শকের এ ব্যয় নিয়ে ফের প্রশ্ন তুলতে যাচ্ছে পরিকল্পনা কমিশন। বলা হচ্ছে, প্রকল্পের পরামর্শকের আধিক্য রয়েছে। আবার একই বিষয়ে দুই বা অধিক পরামর্শকের (বিভিন্ন পর্যায়ে) সংস্থান রাখা হয়েছে। এগুলো আলোচনা করে কমানো যেতে পারে। এছাড়া পরামর্শক ব্যয়ের সঙ্গে গাড়ি ভাড়া বাবদ ৪ কোটি ১৯ লাখ টাকা সংস্থানের যৌক্তিকতা জানতে চাওয়া হবে পিইসি সভায়।
সূত্র জানায়, ৮ সেপ্টেম্বর যে পিইসি সভা হওয়ার কথা ছিল। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অত্যধিক ব্যয় প্রস্তাবের কারণে ওই সভা স্থগিত করা হয়। পিইসি সভার কার্যপত্রে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রস্তুতিমূলক কারিগরি সহায়তার’ জন্য ২৫৬ কোটি ৩১ লাখ টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়। এই ব্যয়ের বেশির ভাগ ১৮০ কোটি ৫০ লাখ ২৯ হাজার টাকা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে ঋণ হিসেবে নেয়া হবে। বাকি ৭৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করার কথা। প্রকল্পের আওতায় মূল কাজ হচ্ছে ১১টি উপ-প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হবে। প্রক্রিয়াকরণ শেষে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পেলে চলতি বছর থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কথা রয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ের।
পিইসি সভার কার্যপত্রে বলা হয়েছে, প্রকল্পের আওতায় সান্তাহার বাইপাসসহ-সান্তাহার-বগুড়া-কাউনিয়া-লালমনিরহাট সেকশনে বিদ্যমান মিটারগেজ লাইনকে ডুয়েলগেজে বা ব্রডগেজ লাইনে রূপান্তর করা হবে। এছাড়া এর সমান্তরাল আরেকটি ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণের জন্য বিশদ ডিজাইনসহ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হবে। এই সেকশনে একমাত্র বিভাগীয় শহর রংপুর। বগুড়া-কাউনিয়া সেকশনে পীরগাছা স্টেশন থেকে রংপুর স্টেশন যেতে কাউনিয়া ঘুরে যেতে হয়। কাউনিয়ায় যেতে রেলের দিক পরিবর্তন (শান্টিং) করতে হয়। তারপর তা রংপুরে আসে। ভবিষ্যতে সব বিভাগীয় শহরের সঙ্গে ননস্টপ ট্রেন চলাচলের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। অন্যান্য বিভাগীয় শহরের মধ্যে একমাত্র বরিশাল ছাড়া বাকিগুলোর সরাসরি রেল যোগাযোগ থাকলেও রংপুরের সঙ্গে নেই। পীরগাছা থেকে রংপুরের দূরত্ব ১৪ কিলোমিটার। পীরগাছা থেকে কাউনিয়ার দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার। আবার কাউনিয়া থেকে রংপুরের দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার। এ অবস্থায় পীরগাছা থেকে রংপুর পর্যন্ত সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপন করা গেলে বগুড়া-গাইবান্ধা৬-রংপুর-দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় সরাসরি রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হতো। সম্প্রতি কাউনিয়া স্টেশনে শান্টিং করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় একজন নিহত ও অনেকেই আহত হয়েছেন বলেও উল্লেখ করেছে পরিকল্পনা কমিশন। কিন্তু এ সুপারিশ বিষয়ে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হবে পিইসি সভায়।
সুত্র:যুগান্তর, ২১ অক্টোবর ২০১৯