শিরোনাম

যাত্রীর অস্বাভাবিক চাপে রেল

যাত্রীর অস্বাভাবিক চাপে রেল

নূরুল ইসলাম:
কমলাপুর স্টেশনে শুধু যাত্রী আর যাত্রী। টিকিট কাউন্টারের সামনে ভিড়, প্লাটফরমে ভিড়, স্টেশন ম্যানেজারের কক্ষে ভিড়। দেখলে মনে হবে ঈদ এসেছে। ঈদের মতোই একটা ট্রেন আসার আগেই প্লাটফরমে তিল ধারণের ঠাঁই মিলছে না। নামার আগে ঠেলা ধাক্কা দিয়ে উঠে পড়ছে যাত্রীরা। স্টেশন ম্যানেজার শীতাংশু চক্রবর্তী জানালেন, ঈদের পর দু’একদিন কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থা ছিল। এরপর থেকে প্রতিদিনই ভিড় বাড়ছে। টিকিটের জন্য হাহাকার লেগেই আছে। প্রতিদিন সকালে কাউন্টারগুলোতে দীর্ঘ লাইন হচ্ছে।

সারাদেশে সড়ক-মহাসড়কের বেহাল অবস্থার কারনে রেলের উপর যাত্রীদের চাপ বেড়েছে। বিশেষ করে দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীরা ট্রেনকেই এখন নিরাপদ ও আরামদায়ক মনে করছেন। মঙ্গলবার রাতে খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেসের টিকিটের জন্য ৫ নম্বর কাউন্টারের লাইনে দাঁড়ানো বেসরকারি চাকরিজীবী মোতাহার হোসেন বলেন, আগে কোনোদিন ট্রেনে যাই নি। এবার রাস্তা ও ফেরীর যে অবস্থা তাতে বাসের চেয়ে ট্রেন অনেক ভালো। কিন্তু টিকিট পাবো কিনা জানি না। ৫ নম্বর কাউন্টারে সিমি নামে এক তরুণী এসেছিলেন যশোর থেকে ঢাকায় আসার ৩০ সেপ্টেম্বরের ফিরতি টিকিট ফেরত দিতে। কেনো ফেরত দিবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২৮ তারিখে যশোর গিয়ে ৩০ তারিখে ফিরবো বলেই আগেভাগে ফিরতি টিকিট সংগ্রহ করেছিলাম। কিন্তু যাওয়ার টিকিট পাই নি। এখন ফিরতি টিকিট দিয়ে কী করবো? প্রায় দুই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ২৯ সেপ্টেম্বরের টিকিট না পেয়ে ফিরে এলেন ব্যবসায়ী ফিরোজ কবীর। বললেন, আগে জানলে এই দুই ঘণ্টা এতো কষ্ট করতাম না। কোথায় যাবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২৯ তারিখে রংপুর এক্সপ্রেসের টিকিটের দরকার ছিল।

ট্রেনে কি সব সময় যাতায়াত করেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগে করতাম না। এখন বাসে রংপুর যেতে ১৬/১৭ ঘণ্টা লাগে। মহাসড়কের বেহাল অবস্থা বর্ণনা করে তিনি বলেন, বগুড়া থেকে রংপুর যেতে ৬ ঘণ্টা লাগছে। পথিমধ্যে এই খরতাপে যানজটের ভোগান্তিতো আছেই। ফিরোজ কবীরের মতো অনেকেই কাঙ্খিত টিকিট না পেয়ে ফিরে গেলেন। রাত ১১টা পর্যন্ত কাউন্টারগুলোতে ভিড় ক্রমেই বাড়তে দেখা গেল। অন্যদিকে, স্টেশন ম্যানেজারের কক্ষেও দেখা গেল টিকিটের জন্য তদবিরকারকদের ভিড়। যাত্রীরা একটার পর একটা ফোন ধরিয়ে দিচ্ছেন স্টেশন মাস্টার সাহা বাবুর কানে। ফোনের ওপাড়ের কেউ এমপি, এমপির পিএস, কেউবা মন্ত্রীর পিএস, কেউবা গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা। আবার এমপির লিখিত চাহিদাপত্র নিয়ে কেউ কেউ হাজির স্টেশন মাস্টারের সামনে। একজন এসেছেন সিলেটের এক এমপির চাহিদাপত্র নিয়ে। ৩০ সেপ্টেম্বর পারাবতের এসি কেবিন প্রয়োজন। স্টেশন মাস্টার জানিয়ে দিলেন আরেক এমপি আগেই ওই দিনের কেবিন বুকিং দিয়েছেন। একই ট্রেনে এক সাথে দুইজন এমপির কোটা নেই। বয়োস্ক এজন গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তার ফোন ধরিয়ে দিয়ে ২৮ সেপ্টেম্বর জামালপুরগামী তিতস্তা এক্সপ্রেসের চারটি টিকিট চাইলেন। টেলিফোনে স্টেশন মাস্টার খানিকটা বিরক্ত হয়ে সাফ জানিয়ে দিলেন, আমার কাছে কোনো টিকিট নেই। কোনো কিছু বলার থাকলে ডিসিও স্যারেকে বলেন। ডিসিও’র ব্যাখ্যা দিয়ে বললেন, ডিভিশনাল কমার্শিয়াল অফিসার। স্টেশনের প্লাটফরমে গিয়ে দেখা গেল উপচে পরা ভিড়। যাত্রীবোঝাই একটি ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে ছাড়ার অপেক্ষায়। দেখা গেল ট্রেনের আসনগুলো যাত্রীতে পরিপূর্ণ। এমনকি দাঁড়িয়েও শত শত যাত্রী। প্রথম শ্রেণি এবং এসি চেয়ারেও অতিরিক্ত যাত্রীর দেখা মিললো।

যানজটের ভোগান্তি এড়াতে মানুষ রেলের দিকে ঝুঁকলেও ট্রেনে আগের মতো সেবা পাওয়া যাচ্ছে না বলে অনেকেরই অভিযোগ। বিশেষ করে গত বছর চালু হওয়া ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানীকৃত লাল-সবজু কোচগুলো অবহলো অযতেœ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সঠিকভাবে পরিস্কার না করায় কোচগুলোর ভেতরের পরিবেশ দুর্গন্ধযুক্ত, ছাড়পোকা, মাকড়সার জালে ভরে গেছে। দিনাজপুরগামী দ্রæতযান এক্সপ্রেসের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করে তানভীর রহমান হীরা জানান, গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে তিনি ঢাকা থেকে পার্বতীপুরের উদ্দেশ্যে রওনা করেন। ট্রেনটি ঢাকা আসার পরেও ড্রাইওয়াস হওয়ার কথা থাকলেও শুধু ঝাড়ু দেয়া হয়। প্রথম শ্রেণির এসি কেবিনের প্রবেশ করে তিনি নোংরা পরিবেশ দেখতে পান। দুর্গন্ধে ভিতরে টেকা যাচ্ছিলো না। টয়লেটও ছিল নোংরা। ভুক্তভোগি যাত্রীদের অভিযোগ, ভারত থেকে আমদানি করা নতুন এলএইবি কোচ দিয়ে ঢাকা-খুলনা রুটে চিত্রা, সুন্দরবন, ঢাকা-রাজশাহী রুটে ধূমকেতু, সিল্কসিটি ও পদ্মা এক্সপ্রেসের শোভন চেয়ারের অবস্থাও নাজুক। কোচগুলোর ছাদে মাকড়সার বাসা, সিটের পেছনে খাবার রাখার ফুডট্রে ময়লা আবর্জনায় ভরা থাকে। তৈরী সাদা ফ্যানগুলোতে ধূলা জমে কালো হয়ে গেছে। ফ্যান ঘুরলে ময়লা এসে গায়ে পড়ে।সাগর নামে এক যাত্রী অভিযোগ করে বলেন, ১৯ সেপ্টেম্বর তিনি সিল্কসিটি এক্সপ্রেসে রাজশাহী থেকে ঢাকায় আসার পথে হিজড়াতের কবলে পড়তে দেখেছেন এক নবজাতকের মাকে। হিজড়ারা তার কাছে ৫০১ টাকা দাবি করে নানাভাবে হেনস্তা করে। অথচ ট্রেনের এটেনডেন্টরা হিজড়াদের নিবৃত করার কোনো উদ্যোগ নেয় না।

লালমনিরহাট গামী লালমনি এক্সপ্রেসের এক যাত্রী অভিযোগ করে বলেন, উত্তরাঞ্চলের দুটি ট্রেনের মধ্যে লালমনি একটি। অথচ এই ট্রেনে যাত্রী সেবা বলে কিছুই নেই। ওই যাত্রীর ভাষায়, ‘হামরা মফিজ বলিয়া না পারতে এখনও এই ট্রেনত চড়ি’।

সুত্র:ইনকিলাব,২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭


About the Author

RailNewsBD
রেল নিউজ বিডি (Rail News BD) বাংলাদেশের রেলের উপর একটি তথ্য ও সংবাদ ভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল।

Comments are closed.