শিরোনাম

শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় করে পেশায় আলো ছড়াচ্ছেন মুক্তা

শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় করে পেশায় আলো ছড়াচ্ছেন মুক্তা

মোরশেদা ইয়াসমিন পিউ

তেজগাঁও রেলক্রসিংয়ে কর্মরত গেটকিপার মুক্তা বেগম। কর্তব্যরত অবস্থায় প্রয়োজনীয় কথা বলার সময়েও তার চোখ ও মন থাকে লাল-হলুদ বাতির দিকে। স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ার তথ্যটি জানাতে যখনি ক্রিং ক্রিং শব্দে ফোন বেজে ওঠে, তখনি উঠে দাঁড়ান মুক্তা। এক পায়ের হাঁটুতে হাত রেখে দ্রুত গিয়ে দাঁড়ান গেটবার নামানোর জন্যে। এরই মধ্যে কোনো কোনো ব্যক্তি গেটবার উপেক্ষা করে ক্রসিং পার হতে চেষ্টা করে। মুক্ত বেগম ধমকের সুরে সাবধান করে বলেন— ‘ডাবল ট্রেন যাইবো। কেউ যাইবেন না, দাঁড়ান… দাঁড়ান…’।

ছয় বছর বয়সে টাইফয়েড জ্বরে মুক্তা বেগমের ডান পা প্যারালাইজড বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যায়। সেই পায়ে পূর্ণশক্তি পান না মুক্তা। ফলে তাকে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলাফেরা করতে হয়। তবে এই প্রতিবন্ধকতা তাকে দমাতে পারেনি। একে জয় করেই পেশায় আলো ছড়াচ্ছেন মুক্তা। লাল বাতি জ্বলে ট্রেন আসার সংকেতে। আর হলুদ বাতি জ্বলে চলে যাওয়ার সংকেতে। এভাবে দিনে ১০০ বার ট্রেন যাওয়া-আসা করে তেজগাঁও ক্রসিং দিয়ে। ৯৯টি ট্রেনের মধ্যে প্রতিদিন প্রায় ৫০টি আসা-যাওয়া করলে মোট ১০০ বার হয়। ২ মিনিট, ৫ মিনিট পর পর গেটবার নামাতে-উঠাতে লাইনে দাঁড়াতে হয় বলে জানান মুক্তা।

কাজে কোনো সমস্যা হয় কি-না জানতে চাইলে বলেন, কাজে সমস্যা নেই। তবে ওয়াশ রুমের সমস্যা ছিল, এখন মোটামুটি ঠিক করে দিয়েছে। তবে পানি বাইরে থেকে কিনে ব্যবহার করতে হয়। এছাড়া রেলক্রসিং পরিষ্কার করতে হয়। পুরুষ সহকর্মীরা ঝাড়ু হাতে নেয় না। তাই মুক্তাকেই একা ঝাড় দেওয়ার কাজটা করতে হয়।

মুক্তা বলেন, চাকরি পাইছি, কিন্তু স্বচ্ছলভাবে চলতে পারি না। অর্থাভাবে আমার মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। স্বামী ছেড়ে চলে গেছে। দুই ছেলে-মেয়ে ও মাকে নিয়ে আমার সংসার। বেতন পাই ৮ হাজার ২৫০ টাকা। এই টাকায় ঘরভাড়া দিয়ে কোনো রকমে শাহজাহানপুর থাকি। তিনি বলেন, অভাবের সংসারে লেখাপড়া বেশি করতে পারি নাই, ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করার পর বিয়ে দিয়ে দেন বাবা-মা। এরপর দুই সন্তানকে নিয়ে নিজের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে শুরু হয় সংগ্রামের জীবন’।

জানা যায়, মুক্তা বেগম ছাড়াও ছয়জন নারী গেটকিপার এ বছর বাংলাদেশ রেলওয়েতে স্থায়ী চাকরি পেয়েছেন। তারা দেশের বিভিন্ন স্টেশনের অধীনে রেলক্রসিংয়ে দায়িত্বে আছেন এবং ভালো কাজ করছেন। ঢাকায় শুধু মুক্তা বেগমই একমাত্র নারী গেটকিপার হিসেবে কাজটি করছেন। দৃঢ়তা নিয়ে কাজটা শুরু করেছেন মুক্তা বেগম। শিফটের কাজে প্রায়ই তাকে সারা রাত এখানে থাকতে হয়। আবার কখনো বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হয়। তবে ভয় পান না তিনি। কাজ শেষ হলে বাড়ি ফেরেন। ঘর সামলিয়ে পরদিন আবার ফেরেন কাজে। তবে নির্ধারিত সময়ের এক মিনিটও হেরফের হয়নি তার আট মাসের চাকরি জীবনে বলে জানান মুক্তা।

মুক্তা বেগমের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার তিতাস থানার গোপালপুর গ্রামে। তবে তার জন্ম ঢাকায়। নতুন এ পেশায় একজন মেয়ে হিসেবে কাজ কেমন লাগছে? মুক্তার উত্তর—‘মেয়েরা সব কাজই পারে। তবে নতুন যেই আসুক, তাকে তো দেখিয়ে, শিখিয়ে দিতে হবে। যারা এখানে আগে থেকে কাজ করেন, তারা প্রথমে দুই দিন দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে কী করতে হয়, এখন সবই পারি।’ বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা (ঢাকা) মো. মাইনুল ইসলাম বলেন, সম্প্রতি গেটকিপার হিসেবে সারাদেশে সাত জন নারী নিয়োগ পেয়েছেন। তার মধ্যে মুক্তা বেগম একজন। ঢাকা বিভাগে সে একাই মেয়ে। তিনি গেটকিপার হিসেবে স্থায়ী চাকরি পেয়েছেন। এখন পর্যন্ত নারীরা ভালোই কাজ করছেন, কাজে ফাঁকি দেন না।

সুতার:ইত্তেফাক, ২৬ অক্টোবর, ২০১৯


About the Author

RailNewsBD
রেল নিউজ বিডি (Rail News BD) বাংলাদেশের রেলের উপর একটি তথ্য ও সংবাদ ভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল।

Comments are closed.