শিরোনাম

৮টার ট্রেন ৮টায় ছেড়েছে, তবে…

৮টার ট্রেন ৮টায় ছেড়েছে, তবে...

কয়েক মাস আগে রংপুর থেকে লালমনিরহাট যাওয়ার জন্য সকালে ট্রেনে উঠেছিলাম। একটি ট্রেনের অবস্থা কতটা বেহাল হতে পারে, তা ওই ট্রেনটি না দেখলে আমার জানা হতো না। ট্রেনের ছাদের ছাউনি ভাঙা। জানালা বন্ধ করা যায় না। কোনো কোনো বেঞ্চ বসার উপযোগী নয়। যাত্রীরা বলছেন, বৃষ্টি হলে ট্রেনের ভেতরে থেকেও ভিজতে হয়। ট্রেনের পরিচালককে জিজ্ঞাসা করলাম, ট্রেনের এ অবস্থা কেন? পরিচালক এ কথার উত্তর না দিয়ে হাজারো সমস্যার কথা বলতে শুরু করলেন। এমনকি সারা দিন ট্রেনে থাকতে হলেও একটি বাথরুম পর্যন্ত ওই ট্রেনে নেই। নিজের চাকরিকেই বলছিলেন অমানবিক।

এটা কোনো নতুন কথা নয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রংপুরে নতুন ট্রেন দেওয়া হয়নি। বছর দুই আগে কয়েক শ লাল-সবুজ বগি ভারত ও ইন্দোনেশিয়া থেকে আনা হয়েছিল। তখন প্রথম আলোয় একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম, ‘লাল-সবুজ বগি কি রংপুর পাবে?’ আশঙ্কাই সত্যি হয়েছিল। লাল-সবুজ বগি পাওয়া যায়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুড়িগ্রামের জনসভায় কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকা যাওয়ার একটি ট্রেনের কথা বলেছিলেন। কিন্তু সেই ট্রেন আলাদা করে দেওয়া হয়নি। শুধু একটি শাটল ট্রেন দেওয়া হয়েছে রংপুর এক্সপ্রেসের সঙ্গে যুক্ত করে।

রংপুর থেকে ঢাকা যাওয়ার জন্য রংপুর এক্সপ্রেস এবং লালমনিরহাট থেকে লালমনি এক্সপ্রেস চলাচল করছে। ট্রেন দুটির চেয়ারগুলোর অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। একটি চেয়ারও হেলানো যায় না। আবার যেটা হেলে আছে, সেটা সোজা হয় না। কোনো কোনো জানালা তো খোলাই যায় না, কোনোটা বন্ধ করা যায় না। অর্ধেক রাস্তা যেতে না যেতেই পানি শেষ হয়। মলমূত্র ত্যাগ করতে হয় লাইনের ওপরই। দুটি ট্রেনই অপরিষ্কার, অপরিচ্ছন্ন। দুর্গন্ধও আছে। আমার কয়েকবারের অভিজ্ঞতা তা-ই বলে।

সম্প্রতি আবারও ঢাকায় গিয়েছিলাম ট্রেনে। রংপুর থেকে ট্রেন ছাড়ার কথা রাত ৮টায়। কোনো কারণ ছাড়াই ট্রেন বিলম্ব। ঠিক অনুমানও করা যায় না কয়টায় ট্রেন ছাড়বে। রাত জেগে এসএমএস দিয়ে বারবার জানার চেষ্টা করি ট্রেন আনুমানিক কখন ছাড়বে। স্টেশনে গেলাম রাত সাড়ে ৩টায়। রাত সাড়ে ৩টা রংপুরের জন্য নিঃসন্দেহে অনিরাপদ সড়ক। যাঁদের বাসা দূরে, তাঁরা কয়েক ঘণ্টা আগে থেকেই স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন। আর যাঁরা ঢাকা থেকে রংপুরে এসেছেন, তাঁরাও স্টেশনে বসে থাকলেন সকাল হওয়ার অপেক্ষায়। স্টেশনে যে অপেক্ষা করার কোনো সুব্যবস্থা আছে, তা-ও নয়। স্টেশনে অপেক্ষা মানে প্ল্যাটফর্মে হাঁটাহাঁটি। রংপুর এক্সপ্রেস ছেড়েছিল ভোর সোয়া ৪টায়। সোয়া ৮ ঘণ্টা বিলম্ব। ট্রেনে পাশেই যাঁরা বসেছেন, তাঁদের মধ্যে বৃদ্ধ-রোগী-শিশু সবাই আছেন। তঁারা একটু আরামে যাওয়ার জন্যই ট্রেনে উঠেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ট্রেন যখন ঢাকায় পৌঁছাল, তখন ১২ ঘণ্টা বিলম্ব। এই যে ট্রেন ভ্রমণের কষ্ট-ভোগান্তি—এর দায় কে নেবে? ট্রেন চলার সময় ট্রেনের পরিচালককে অনেকেই জিজ্ঞাসা করছিলেন, ট্রেন কেন বিলম্ব? ট্রেনের পরিচালক অসহায়ের মতো কোনো কথার উত্তর দিতে না পেরে দ্রুত প্রস্থান করেন।

ঢাকা থেকে একবার লালমনি এক্সপ্রেসে গিয়েছিলাম। রাত ১০টায় ঢাকা থেকে ট্রেনটি ছাড়ার কথা। বিমানবন্দর স্টেশনে গিয়ে ট্রেনের অপেক্ষা করছি। এসএমএস–পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা হলো, ট্রেন কত ঘণ্টা বিলম্বে কয়টায় ছাড়বে, তা জানা যায় না। ফলে আগে গিয়ে স্টেশনে বসে থাকলাম। রাত ১০টার পরের সব ট্রেন ছেড়ে গেল কিন্তু লালমনি এক্সপ্রেস আসে না। রাত ১১টা, ১২টা, ১টা পার হয় কিন্তু ট্রেন আসে না। রাত ১টার সময় স্টেশনমাস্টারের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ট্রেন কখন আসবে? তিনিও বলতে পারেন না। ওই রাতে ট্রেনের টিকিট আর তাঁরা ফেরত নিতেও সম্মত নন। রাত ২টার পরে ট্রেন এল। রাত ২টা পর্যন্ত শত শত যাত্রী ক্ষুব্ধ হয়ে বসে ছিলেন। যে ট্রেন সকালে লালমনিরহাটে পৌঁছার কথা, সেই ট্রেনটি পরদিন বিকেলে লালমনিরহাটে পৌঁছায়।

একজন পরিচর্যকের কাছে ট্রেন বিলম্ব হওয়ার কয়েকটি কারণ জানতে পারলাম। তিনি নিজের নাম লিখতে নিষেধ করেছেন। প্রথমত, তাঁর অভিযোগ রংপুর এবং লালমনিরহাটের পথে যে ট্রেনগুলো দেওয়া হয়, সেগুলো অন্য লাইনে অচল হওয়ার পর। ফলে অচল ট্রেন নিয়ে মাঝে মাঝেই বিপদে পড়তে হয়। দ্বিতীয়ত, ট্রেনগুলোর নিয়ন্ত্রণ হয় ঢাকা থেকে। কোনো স্টেশনে যদি ক্রসিং থাকে, তাহলে রংপুর এবং লালমনি এক্সপ্রেসকে দাঁড় করিয়ে অন্য ট্রেন ছেড়ে দেওয়া হয়। যদি সেটি লোকাল ট্রেনও হয়। তৃতীয়ত, ট্রেন ঢাকা পৌঁছার পর পরিষ্কার করা হয়। এখানে ৪০ মিনিটের স্থলে প্রায় ২ ঘণ্টা নষ্ট হয়। এসব কারণে ট্রেন বিলম্ব হয়।

ট্রেনের এত সমস্যা সত্ত্বেও সম্প্রতি আবারও ঢাকা যাই সেই ট্রেনেই। সড়কপথে প্রতিদিন ভয়াবহ দুর্ঘটনার খবর পড়ে, ওপথে যেতে ইচ্ছে করেনি। এবার ৮টার ট্রেন ছাড়ল ৮টায়। তবে রাত ৮টায় নয়, পরদিন সকাল ৮টায়। একজন পরিচর্যক জানালেন, ১৮ ঘণ্টা বিলম্বেও কখনো কখনো ট্রেন ছেড়েছে। মনে মনে ভাবলাম, ৬ ঘণ্টা আগেই ট্রেন এসেছে। কাজী তানভির নামের একজন তরুণ যাত্রী বলছিলেন, ‘একে তো বাংলাদেশের ট্রেন, তার ওপর রংপুরের, এর চেয়ে আর ভালো কী সেবা পাওয়া সম্ভব!’

পথে কোনো সমস্যা নেই, তারপরও ট্রেনের সময়সূচিতে এতটাই বিপর্যয়। এগুলো থেকে উত্তরণের কোনো পথ কি নেই? রংপুরের দিকে আসা ট্রেনগুলোর কোনো অভিভাবক নেই। ফলে কোনো জবাবদিহি করতে হয় না। রেল নিয়ে সরকারের ন্যূনতম জবাবদিহি থাকলে ট্রেনের এত বিপর্যয় হতো না। রেলমন্ত্রী, রেলসচিব, রেল অধিদপ্তরের মহাপরিচালক—তাঁদের কারও কোনো জবাবদিহি কখনোই করতে হবে না? তাহলে তাঁরা মন্ত্রণালয়, সচিবালয়, অধিদপ্তরের প্রধান হয়ে কী করেন?

রংপুর রেলের সর্বাধিক খারাপ সময় সম্ভবত এখন যাচ্ছে। রংপুর এক্সপ্রেসের সেবা কখনোই ভালো ছিল না। তবে সময় মোটামুটি ঠিক ছিল। এখন সেবাও নেই, সূচিরও ঠিক নেই। বাংলাদেশের যাঁরা রংপুরে জন্ম নিয়েছেন, তাঁদের জন্মটাই অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে দিয়েছে। তবে কি নিয়তির কাছে নিজেদের সঁপে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই?

লেখক:
তুহিন ওয়াদুদ রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং রিভারাইন পিপল–এর পরিচালক

সুত্র:প্রথম আলো, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮


About the Author

RailNewsBD
রেল নিউজ বিডি (Rail News BD) বাংলাদেশের রেলের উপর একটি তথ্য ও সংবাদ ভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল।

3 Trackbacks & Pingbacks

  1. relaxing piano
  2. แทงหวย
  3. casino

Comments are closed.