শিরোনাম

অপরিকল্পিত ডাবল লাইন ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ

অপরিকল্পিত ডাবল লাইন ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ

ইসমাইলআলী: ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ ডাবল লাইন করতে গত এক দশকে দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে রেলওয়ে। এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। তবে রেলপথটি রয়ে গেছে মিটারগেজই। ব্রডগেজ তথা ডুয়েলগেজে রূপান্তরের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এতে ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে করিডোর তথা আন্তর্জাতিক রুটে যুক্ত হতে পারবে না চট্টগ্রাম। আবার দেশের উত্তর বা দক্ষিণাঞ্চল থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত সরাসরি কোনো ট্রেনও চালানো যাবে না।

অপরিকল্পিত এ দুই প্রকল্প নিয়ে খোদ রেলপথ মন্ত্রণালয় প্রশ্ন তুলেছিল। যদিও এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি রেলওয়ে। তবে এখন রেলপথটি ডুয়েলগেজে উন্নীত করতে নতুন প্রকল্প গ্রহণের চিন্তাভাবনা চলছে। এতে ব্যয় হবে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা।

ইউএন-এসকাপের এক প্রতিবেদনে ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে কানেক্টিভিটির অন্যতম বাধা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় বাংলাদেশের মিটারগেজ-ব্রডগেজ রেলপথের ভিন্নতাকে। এতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক রেলওয়ে কানেক্টিভিটির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তান, ভারত হয়ে রেলপথে চীনে যেতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার অতিক্রম করতে হবে। এজন্য ট্রান্স-এশিয়ান রেলপথের অন্যতম সদস্য বাংলাদেশ। কিন্তু দেশটির রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত ব্রডগেজ রেলপথ থাকলেও এরপরের পুরোটাই মিটারগেজ। ফলে চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক কানেক্টিভিটির বাইরে থেকে যাচ্ছে।

সূত্রমতে, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের মধ্যে টঙ্গী-ভৈরববাজার অংশটি ডাবল লাইন নির্মাণে ২০০৬ সালে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। আর ২০০৮ সালে লাকসাম-চিনকি আস্তানা অংশটি ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ২০১১ সালে উভয় প্রকল্প সংশোধন করা হয়। সে সময় প্রকল্প দুটির ব্যয় বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। এর মধ্যে টঙ্গী-ভৈরববাজার ডাবল লাইন নির্মাণে ব্যয় হয় দুই হাজার ১২২ কোটি ৬১ লাখ টাকা। আর লাকসাম-চিনকি আস্তানা ডাবল লাইন নির্মাণে ব্যয় হয় এক হাজার ৬০৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। যদিও ব্যয় কমানোর যুক্তিতে প্রকল্প দুটিতে ডুয়েলগেজের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি।

এদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের অবশিষ্ট অংশ (আখাউড়া-লাকসাম) মিটারগেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রস্তাব ২০১৬ সালে পাঠানো হয় একনেক (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি) সভায়। তবে সে সময় প্রকল্পটি ফেরত দেন প্রধানমন্ত্রী। সে সময় তিনি নির্দেশনা দেন, দেশে আর কোনো মিটারগেজ রেলপথ হবে না। নতুন রেলপথ ব্রডগেজ বা ডুয়েলগেজ নির্মাণের নির্দেশনা দেওয়া হয় সেই একনেক সভায়। এতে শুধু আখাউড়া-লাকসাম অংশটি ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন করা হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের মিটারগেজ অংশগুলো ডুয়েলগেজ ডাবল লাইনে উন্নীত করার জন্য সম্ভাব্য যাচাই শুরু করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, এখন ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণে ব্যয় হবে কমপক্ষে ৫০ হাজার কোটি টাকা। আর ২০৩৫ সালের আগে তা শেষ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আখাউড়া-লাকসাম ডাবল লাইনের মতো টঙ্গী-ভৈরববাজার ও লাকসাম চিনকি আস্তানা ডাবল লাইন নির্মাণের সময়ই ডুয়েলগেজে উন্নীত করলে ব্যয়ও অনেক কম হতো।

তথ্যমতে, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের মধ্যে টঙ্গী-ভৈরববাজার ও লাকসাম-চিনকি আস্তানা ডাবল লাইন মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে ৭ ফুটের কংক্রিট সিøপার ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ ৯ ফুটের কংক্রিট সিøপার ব্যবহার করা হলে এক সিøপারেই ব্রডগেজ তথা ডুয়েলগেজ রেলপথ চালু করা যেত। ফলে রেলপথটিতে ব্রডগেজের ব্যবস্থা রাখতে খুব বেশি বিনিয়োগ করতে হতো না। আবার ডুয়েলগেজ রেলপথ চালু করতে সময়ও লাগত কয়েক মাস। শুধু অতিরিক্ত একটি রেলপাত সংযোজন করলেই চলত।

যদিও বর্তমান অবস্থায় ব্রডগেজ তথা ডুয়েলগেজ রেলপথ চালু করতে প্রচুর সময় ব্যয় হবে। পুরো রেললাইন তুলে নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। এমনকি রেলপথে থাকা ছোট ব্রিজ-কালভার্টগুলো ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। এতে বিনিয়োগও করতে হবে অনেক বেশি।

এ নিয়ে ২০১৬ সালে রেলওয়ের কাছে ব্যাখ্যা চায় রেলপথ মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়েছিল, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলওয়ের অন্যতম চাহিদাসম্পন্ন রুট। এছাড়া আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহনে এটি একমাত্র রেল রুট। ফলে রেলপথটি ডাবল লাইনে উন্নীত করা জরুরি। তবে ঢাকা-চট্টগ্রাম ডাবল লাইন নির্মাণে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করা হলেও এর পরিপূর্ণ সুফল পাওয়া যাবে না। কারণ আন্তর্জাতিক কানেক্টিভিটির বাইরেই থেকে যাচ্ছে চট্টগ্রাম। কেন টঙ্গী-ভৈরববাজার ও লাকসাম-চিনকি আস্তানা প্রকল্প দুটিতে ডুয়েলগেজের ব্যবস্থা রাখা হয়নি, তা জানতে চাওয়া হয় সে সময়।

এর জবাবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের টঙ্গী পর্যন্ত মাত্র ২২ কিলোমিটার ব্রডগেজ রয়েছে। বাকি ৩০৮ কিলোমিটার পথই মিটারগেজের। এছাড়া পুরো রেলপথটি তখনই ব্রডগেজ করা যেত না। ফলে ব্রডগেজ সিøপার ব্যবহার করলেও তা অপ্রয়োজনীয় পড়ে থাকত। এছাড়া দুর্নীতি বা অনিয়মের অভিযোগ উঠত বলে রেলপথটিতে মিটারগেজ সিøপার ব্যবহার করা হয়েছে।

রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ আরও জানায়, ডাবল লাইন নির্মাণের সময় রেলপথটির মাটির কাজ করা হয়েছে ব্রডগেজ স্ট্যান্ডার্ড ধরে। এছাড়া দ্বিতীয় ভৈরব, দ্বিতীয় তিতাস সেতুতে ব্রডগেজ অপশন রাখা আছে। শুধু ২০৭ কিলোমিটার রেলপথ হচ্ছে মিটারগেজের। যখন ব্রডগেজ প্রয়োজন হবে, তখন আরেকটি প্রকল্প নিয়ে সিøপার ও রেলপাতগুলো বদলে ফেলা যাবে।

রেলওয়ের পরিকল্পনা বিভাগ বলছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম ডাবল লাইনে ব্রডগেজের ব্যবস্থা রাখতে সে সময় অতিরিক্ত ২০০ কোটি টাকা ব্যয় করলেই চলত। এক্ষেত্রে স্লিপারগুলো শুধু ব্রডগেজের ব্যবহার করলেই হতো। এতে অন্তত দুই হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা যেত। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় ব্রডগেজ করতে নতুন করে স্লিপার বদলাতে কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি রেলপথের একটি অংশ বন্ধ রেখে কাজ করতে হবে।

উল্লেখ্য, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের মধ্যে আখাউড়া-লাকসাম ৭২ কিলোমিটার অংশ বর্তমানে ডাবল লাইন ডুয়েলগেজ নির্মাণকাজ চলছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ছয় হাজার ৫০৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।

সুত্র:শেয়ার বিজ, ফেব্রুয়ারী ১৯, ২০২০


About the Author

RailNewsBD
রেল নিউজ বিডি (Rail News BD) বাংলাদেশের রেলের উপর একটি তথ্য ও সংবাদ ভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল।

Comments are closed.