শিরোনাম

অবিশ্বাস্য বেতনের প্রস্তাব বাংলাদেশ রেলওয়ের

অবিশ্বাস্য বেতনের প্রস্তাব বাংলাদেশ রেলওয়ের

হামিদ-উজ-জামান:
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, একজন ক্লিনারের বেতন প্রতি মাসে ৪ লাখ টাকার বেশি দেয়ার প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। শুধু ক্লিনার নয়, সরকারের এ সংস্থাটির যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ২৫৬ কোটি টাকার কারিগরি প্রকল্পে বিভিন্ন পর্যায়ের স্টাফদের বেতনের প্রস্তাবে অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।
এ বেতন ‘অস্বাভাবিক ও অগ্রহণযোগ্য’ এমন মন্তব্য করে সংশোধনের জন্য প্রস্তাবটি রেল মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠিয়েছে। যদিও এটি ভুল হয়েছে বলে দাবি করেছে রেল কর্তৃপক্ষ।

অর্থনীতিবিদদের ধারণা, এটি ভুল বলে উড়িয়ে দিলে চলবে না। এতবড় প্রকল্প প্রস্তাবে এ ধরনের ভুল হতে পারে না। কারণ এ ধরনের প্রস্তাব তৈরি করার আগে কয়েক ধাপে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার বিধান রয়েছে। এমন ভুল যারা করেন তাদের কোনোভাবেই চাকরি থাকা উচিত নয়। এটিও একটি বড় ধরনের দুর্নীতি।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রস্তুতিমূলক কারিগরি সহায়তার’ জন্য ২৫৬ কোটি ৩১ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্প প্রস্তাব করে রেলপথ মন্ত্রণালয়।

এর মধ্যে ১৮০ কোটি ৫০ লাখ ২৯ হাজার টাকা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে ঋণ হিসেবে নেয়া হবে। বাকি ৭৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করার কথা।

আরও জানা গেছে, ৮ সেপ্টেম্বর পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু স্টাফদের অস্বাভাবিক বেতনের প্রস্তাব আসায় সেই বৈঠক স্থগিত করা হয়। ওই বৈঠকের কার্যপত্রে বলা হয়েছে, ‘সহায়তা স্টাফদের জন্য বেতন ধরা হয়েছে অস্বাভাবিক।

উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবের (ডিপিপি) ৯৫নং পৃষ্ঠায় সাপোর্ট স্টাফদের বেতন দেয়া হয়েছে। তাতে দেখা যায়- ক্লিনারের বেতন প্রতি মাসে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা। অফিস সহায়ক, ফটোকপি অপারেটর, কম্পিউটার অপারেটর, ফিল্ড কো-অর্ডিনেটরের বেতন প্রতি মাসে ৮৩ হাজার ৯৫০ টাকা, বিদেশি পরামর্শকের মাসিক বেতন ১৬ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকা এবং ক্যাড অপারেটরের বেতন মাসে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা (যা সাধারণত ৫০-৭৫ হাজার)। এসব ব্যয় অত্যধিক।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বুধবার যুগান্তরকে বলেন, পরিকল্পনা কমিশন থেকে ইতিমধ্যে বলা হয়েছে, এ ব্যয় বেশি হয়েছে। এটা অযৌক্তিক। তাদের ব্যাখ্যা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। ব্যাখ্যা না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। পৃথিবীতে কেউ এরকম চাইতে পারে? কে চাইতে পারে? অস্বাভাবিক কিছু কেউ চাইবে না। কেউ চাইলে বুঝিয়ে বলুক। একজন ক্লিনার কি ক্লিনার? নিউক্লিনিয়ার ক্লিনার হলে তার বেতন ১৫ লাখও হতে পারে, সেটা অন্য কথা। কিন্তু ক্লিনার বলতে আমরা যা বুঝি তা হচ্ছে যারা ঘর পরিষ্কার করেন। তার বেতন এটা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু দেখা যায় যদি তিনি পারমাণবিক বর্জ্য ক্লিন করেন তাহলে তার বেতন অনেক হতে পারে। আমি এটা বলতে পারি, অযৌক্তিক কোনো কিছু আমার এখান থেকে যাবে না।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, এটা ভুল হয়েছে। আমরা ভুল বুঝতে পেরে পিইসি সভার আগেই প্রস্তাবটি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছি। তাছাড়া শুধু বেতনই নয়, পুরো প্রস্তাবটিই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হয়েছে আর কোথাও কোনো ভুলভ্রান্তি আছে কিনা। সংশোধনের পর আমরা প্রকল্প প্রস্তাবটি পুনরায় পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এটা তো জনগণের অর্থের অপচয়। এটা অবশ্যই দুর্নীতি। মূল কথা হচ্ছে, এরকম অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না। বিচারহীনতার জন্য এসব দুর্নীতি হচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রকৃত বিষয়টি কি তা তদন্ত করে দেখা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে প্রশাসনিক এবং আইনগত দুই ধরনেরই ব্যবস্থা নিতে হবে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অবশ্যই এটা বড় ধরনের দুর্নীতি।

প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়, ১১টি প্রকল্পে সম্ভাব্যতা সমীক্ষাসহ আনুষঙ্গিক কাজ সমাধান করা জন্য পরামর্শক থাকবেন ১ হাজার ৪৩৪ জন। এর মধ্যে বিদেশি পরামর্শক ১ হাজার ১৫৩ জন এবং স্থানীয় ২৮১ জন। এছাড়া প্রজেক্ট ভিউয়ার টিম (ব্যক্তি পরামর্শক) থাকবেন আরও ৯৬ জন।

১৮ জনবল এবং ৯ জন স্টাফ আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে নিয়োগ করা হবে। পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে এক্ষেত্রে বলা হয়, সেবা ক্রয়ে মাত্র দুটি প্যাকেজ করা হয়েছে। পরামর্শক সেবার মূল প্যাকেজটির মূল্য ২৩৮ কোটি ২১ লাখ টাকা। এর আওতায় সব কাজই করা হবে। সম্ভবত একটি ফার্মের মাধ্যমে এ কাজ করা হবে। প্রকল্পভুক্ত ১১টি উপ-প্রকল্পের কাজ একক প্যাকেজের পরিবর্তে ৪-৫টি প্যাকেজে করা যায় কিনা তা পুনঃপর্যালোচনা করতে হবে।

পরিকল্পনা কমিশন বলছে, প্রকল্পে সব মিলে ১ হাজার ৫৩০ জন পরামর্শক রাখা হয়েছে। প্রকল্পে পরামর্শকের আধিক্য রয়েছে। আবার একই বিষয়ে দুই বা ততোধিক পরামর্শকের সংস্থান রাখা হয়েছে, এগুলো আলোচনা করে হ্রাস করা যেতে পারে।

আন্তর্জাতিক পরামর্শকের বেতন প্রতি মাসে ২৫ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। এ খাতে ব্যয় প্রতি মাসে গড়ে ১৬ লাখ টাকা। সম্প্রতি অনুমোদিত এডিবির সমজাতীয় প্রকল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এ ব্যয় যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করতে হবে। আবার পরামর্শক ব্যয়ের সঙ্গে গাড়ি ভাড়া বাবদ ৪ কোটি ১৯ লাখ ৯৭ হাজার টাকা ধরা হয়েছে। এ ব্যয়ের যৌক্তিকতা জানা প্রয়োজন।

এসব বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকনোমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এটাকে ভুল বলে উড়িয়ে দিলে চলবে না। কেননা এটা একজনের ভুল নয়। মন্ত্রণালয়ের ভেতরে বিভিন্ন পর্যায়েই ধাপে ধাপে প্রকল্প প্রস্তাবটি যাচাই-বাছাই হয়েছে। তার মানে এটা সমন্বিত ভাবেই ভুল করা হয়েছে। এটা ইচ্ছে করে করা হয়েছে কিনা বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে। এটাকে দুর্র্নীতি, খামখেয়ালি সবকিছুই বলা যায়। তাছাড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে। এরকম অযোগ্য কর্মকর্তাদের চাকরি থাকা উচিত নয়।

যে ১১টি উপ-প্রকল্পের জন্য এ কারিগরি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ওপর বিদ্যমান রেলসেতুর সমান্তরালে নতুন একটি সেতু নির্মাণের জন্য বিশদ নকশাসহ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রকল্প।

এছাড়া আবদুলপুর-রাজশাহী সেকশনে আরেকটি সমান্তরাল ব্রডগেজ লাইনের জন্য বিশদ ডিজাইনসহ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, সান্তাহার থেকে রোহনপুর নতুন ব্রডগেজ লাইনের জন্য বিশদ ডিজাইনসহ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, সান্তাহার-বগুড়া-কাউনিয়া-লালমনিরহাট সেকশনে বিদ্যমান মিটারগেজ লাইনকে ডুয়েলগেজ লাইনের জন্য বিশদ ডিজাইনসহ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত কর্ড লাইনের সমান্তরাল নতুন ব্রডগেজ লাইনের জন্য বিশদ ডিজাইনসহ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, যশোর থেকে বেনাপোল সমান্তরাল নতুন ব্রডগেজ লাইনের জন্য বিশদ ডিজাইনসহ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা এবং বাংলাদেশ রেলওয়ের রোলিং স্টকের ভবিষ্যৎ চাহিদা পর্যালোচনা এবং রোলিং স্টকের মেইনটেন্যান্স সুবিধার পুনঃস্থানান্তর, পুনঃনকশা, পুনঃনির্মাণ এবং নতুন নির্মাণের জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা।

সুত্র:যুগান্তর, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯


About the Author

RailNewsBD
রেল নিউজ বিডি (Rail News BD) বাংলাদেশের রেলের উপর একটি তথ্য ও সংবাদ ভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল।

Comments are closed.