শিরোনাম

সিলেট-আখাউড়া রেলপথ এক আতঙ্কের নাম

সিলেট-আখাউড়া রেলপথ এক আতঙ্কের নাম

নিউজ ডেস্ক: আখাউড়া-সিলেট রেলপথের কুলাউড়ায় ২০৬ নম্বর মনু রেল সেতুর কাঠের স্লিপার ২০৮টি। এর অর্ধেক ২০১৬ সাল থেকেই নষ্ট। স্লিপারগুলো যাতে সরে না যায়, সে জন্য এগুলোর উপর ফালি করা বাঁশ পেরেক ঠুকে ‘শক্ত’ করে লাগিয়ে রাখতেন রেলকর্মীরা। তার পরও ট্রেন যখন চলত, নাট-বল্টু খুলে স্লিপারগুলো সরে যেত। কয়েকদিন পরে রেলকর্মীরা আবার সেগুলো ঠিক করতেন।


সিলেট-আখাউড়া রেলপথের দৈর্ঘ্য ১৭৯ কিলোমিটার। জরাজীর্ণ হয়ে পড়া এ সেকশনে রয়েছে ১৩টি মহাঝুঁকিপূর্ণ সেতু, রেলওয়ের ভাষায় যার নাম ‘ডেড স্টপ’। ডেড স্টপ মানেই সেখানে সব ধরনের ট্রেন দাঁড়াবে। ডেড স্টপ ছাড়াও পুরো রেলপথই ত্রুটিপূর্ণ। প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। গত পাঁচ মাসে ঘটেছে অন্তত ১১টি দুর্ঘটনা। এতে বড় অংকের আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি মৃত্যু হয়েছে পাঁচজনের। ঘন ঘন দুর্ঘটনার কারণে এ সেকশনে ট্রেনের সময়সূচিও ঠিক থাকছে না। রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, সিলেট-কুলাউড়া-আখাউড়া সেকশনে আগে ট্রেন চলত ঘণ্টায় ৭০-৮০ কিলোমিটার গতিতে। এখন তা অর্ধেকে, অর্থাৎ ৪০ কিলোমিটারে নেমে এসেছে।


বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশে প্রতি কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় সর্বোচ্চ। উচ্চব্যয়ে রেলপথ নির্মাণের প্রকল্প নিতে বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তারা যতটা উৎসাহী, ততটাই নিরুৎসাহ বিদ্যমান রেলপথ ও রেলসেতু সংস্কারে। জীর্ণ রেলপথ আর সেতুর কারণেই মূলত রেলপথ থেকে ছিটকে পড়ছে বগি, ইঞ্জিন ও চাকা। আখাউড়া-সিলেট সেকশনের একজন প্রকৌশলী বলেন, পাহাড়ি ও আঁকাবাঁকা সড়ক হওয়ায় আখাউড়া-সিলেট সেকশনের রশিদপুর থেকে মাইজগাঁও পর্যন্ত সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। জরাজীর্ণ লাইন, মেয়াদোত্তীর্ণ সেতু ও পুরনো কোচের কারণে এ সেকশনে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে।


রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের তথ্যমতে, আখাউড়া-সিলেট রেলপথে পারাবত, জয়ন্তিকা, পাহাড়িকা, উদয়ন, উপবন ও কালনী এক্সপ্রেস ট্রেনে প্রতিদিন ১২ থেকে ১৫ হাজার যাত্রী ঢাকা-সিলেট-ঢাকা ও সিলেট-চট্টগ্রাম-সিলেট রুটে যাতায়াত করে। স্থানীয় সূত্র জানায়, সিলেট-আখাউড়া রেল সেকশনের মোগলাবাজার থেকে মাইজগাঁও পর্যন্ত অধিকাংশ জায়গায় স্লিপারের নাটবল্টু খুলে গেছে। আবার কোথাও কোথাও নাটবল্টু ঢিলা থাকায় রেললাইন নড়বড়ে হয়ে আছে। রেলের দুই স্লিপারের মাঝে পর্যাপ্ত পাথরও নেই।


এ সেকশনের সেতুগুলোর অবস্থা আরো নাজুক। রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের তথ্যমতে, নির্মাণের ৫০-৫৫ বছর পরই সেতুর মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। অথচ এ রুটের ৯০ শতাংশ সেতুর বয়সই ৭০ বছর পেরিয়েছে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এ ধরনের ১৩টি সেতুকে ‘ডেড স্টপ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, ডেড স্টপ হিসেবে চিহ্নিত করা সেতুর আগে সব ধরনের ট্রেন থেমে যাবে। পরে পাঁচ কিলোমিটার গতিতে চলা শুরু করবে। সিলেট থেকে মোগলাবাজার স্টেশন পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে আটটি ও মোগলাবাজার থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ১৬৪ কিলোমিটারের মধ্যে পাঁচটি সেতু ডেড স্টপ হিসেবে চিহ্নিত।
রেলওয়ের প্রকৌশল শাখা সূত্রে জানা গেছে, সিলেট-আখাউড়া সেকশনের অতিঝুঁকিপূর্ণ সেতুগুলোর মধ্যে রয়েছে শমশেরনগর-টিলাগাঁও সেকশনের ২০০ নম্বর সেতু, মোগলাবাজার-মাইজগাঁও সেকশনের ৪৩, ৪৫ ও ৪৭ নম্বর সেতু, কুলাউড়া-বরমচাল সেকশনের ৫ ও ৭ নম্বর সেতু, সাতগাঁও-শ্রীমঙ্গল সেকশনের ১৪১ নম্বর সেতু, শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সেকশনের ১৫৭ নম্বর সেতু, মাইজগাঁও-ভাটেরাবাজার সেকশনের ২৯ নম্বর সেতু ও মনতলা-ইটাখোলা সেকশনের ৫৬ নম্বর সেতু। এ সেতুগুলো সংস্কারের কোনো প্রকল্প না থাকায় এখনই এগুলো সংস্কারের সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত পাঁচ মাসে সিলেট-আখাউড়া রেললাইনে ১১টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ গত ৪ অক্টোবর সকালে আখাউড়ায় জালালাবাদ এক্সপ্রেস ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হওয়ায় ২ ঘণ্টা বন্ধ ছিল চট্টগ্রামের সঙ্গে সিলেটের রেল যোগাযোগ।
এর আগে গত ৪ সেপ্টেম্বর সকালে চট্টগ্রাম থেকে সিলেটগামী জালালাবাদ এক্সপ্রেস ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁও এলাকায় দুর্ঘটনার শিকার হয়। এরপর ১৭ সেপ্টেম্বর একই এলাকায় একই ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হয়। একটি বগির চারটি চাকা লাইন থেকে সরে যাওয়ায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। রেলওয়ের প্রকৌশল শাখার একাধিক কর্মকর্তা মনে করেন, ট্রেনের পুরনো ইঞ্জিন ও বগির কারণেও এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে জালালাবাদ ট্রেনের বগি সবচেয়ে পুরনো হওয়ায় এ ট্রেন বেশি দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে।
গত ১৬ আগস্ট ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁওয়ে যাত্রীবাহী উপবন এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার শিকার হয়। রাত সাড়ে ১০টার দিকে এ ট্রেনের একটি বগির চারটি চাকা লাইনচ্যুত হলে ১৫-২০ জন যাত্রী আহত হয়।
গত ১৯ ও ২০ জুলাই কুলাউড়া জংশন এলাকায় দুটি দুর্ঘটনা ঘটে। ১৯ জুলাই সকালে সিলেট থেকে ছেড়ে আসা ঢাকামুখী জয়ন্তিকা এক্সপ্রেসের একটি বগি কুলাউড়ায় লাইনচ্যুত হয়। এতে কয়েকজন যাত্রী আহত হয়। পরদিন ২০ জুলাই সিলেট থেকে ছেড়ে যাওয়া ঢাকামুখী আন্তঃনগর কালনী এক্সপ্রেস ট্রেনটি একই স্থানে দুর্ঘটনায় পড়ে। এতে সারা দেশের সঙ্গে সিলেটের রেল যোগাযোগ আড়াই ঘণ্টা বন্ধ থাকে।
গত ৭ জুলাই ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া সিলেটগামী জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস কুলাউড়ার হাজিপুরের পলকি ও মনু ব্রিজের মাঝখানে একটি গরুকে ধাক্কা দেয়। ঘটনাস্থলে গরুটি মারা যায়। এতে ইঞ্জিনের সামনের একটি হোস পাইপ ভেঙে ঘটনাস্থলে ট্রেনটি থেমে যায়। বিকল হয়ে যায় ইঞ্জিন।
এ রুটে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটে ২৩ জুন মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার বরমচাল এলাকায়। এ দুর্ঘটনার শিকার হয় ঢাকামুখী উপবন এক্সপ্রেস। ব্রিজ থেকে ট্রেনের পাঁচটি বগি ছিটকে পড়ে পাঁচজন নিহত ও ৬৭ জনের মতো আহত হয়। ওই দুর্ঘটনার ২১ ঘণ্টা পর ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়। এছাড়া গত ২ জুন হবিগঞ্জের বাহুবলের রশিদপুরে কুশিয়ারা ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। এতে সারা দেশের সঙ্গে সিলেটের রেল যোগাযোগ ১৬ ঘণ্টা বন্ধ ছিল।
আখাউড়া-সিলেট ঝুঁকিপূর্ণ রেলপথ নিয়ে ট্রেন যাত্রীরা বরাবরই আতঙ্কের মধ্যে থাকেন। আলাপকালে নিয়মিত ট্রেনে যাতায়াত করেন এমন কয়েকজন যাত্রী বলেন, কখন কি হয় সে ভয়ে থাকি। এই রুটে রেললাইনের যে অবস্থা তা দেখলে ভয় লাগারই কথা। রেল কর্তৃপক্ষের উচিত যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব এ রুটের রেললাইন ও ব্রিজ মেরামতসহ উন্নত করা। সিলেটকে দেশের অন্যতম প্রধান পর্যটন অঞ্চল উল্লেখ করে যাত্রীরা বলেন, দেশের স্বার্থে সিলেট রুটকে উন্নত করা উচিত। তাতে যাত্রীরাও উপকৃত হবে, রেলও লাভবান হবে।

সুত্র:ইনকিলাব, ২৫ অক্টোবর, ২০১৯

<

About the Author

RailNewsBD
রেল নিউজ বিডি (Rail News BD) বাংলাদেশের রেলের উপর একটি তথ্য ও সংবাদ ভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল।

Comments are closed.