পার্থ সারথি দাস : রাজধানী ঢাকা থেকে ২০ মার্চ রাতে ছেড়ে যাওয়া আন্ত নগর তূর্ণা নিশীথা ট্রেনটি ছুটে চলছিল চট্টগ্রাম অভিমুখে। পরদিন ভোর ৪টায় ফেনীর ফতেহপুর লেভেলক্রসিং অতিক্রমের সময় ট্রেনটির সঙ্গে ধাক্কা খায় একটি কাভার্ড ভ্যান। এতে ওই ভ্যানের চার আরোহী প্রাণ হারায়। দায়িত্বপ্রাপ্ত গেটম্যান ওই সময় লেভেলক্রসিংয়ে ছিল না বলে স্থানীয় সূত্রে জানা যায়।
দেশের প্রায় আড়াই হাজার রেলওয়ে লেভেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় এভাবে প্রাণহানির চিত্র বরাবরের। রেলওয়ের পরিসংখ্যান অনুসারে, গত তিন বছরে ৮৩৭টি দুর্ঘটনায় দেড় শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এর মধ্যে অরক্ষিত ও অননুমোদিত লেভেলক্রসিংয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের হিসাব অনুযায়ী, দেশে দুই হাজার ৫৪১টি লেভেলক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে অননুমোদিত এক হাজার ৭৬১টি। সে হিসাবে ৬৯ শতাংশ ক্রসিংই অনুমোদনহীন। তার ওপর বৈধগুলোর মধ্যেও গেটম্যান আছে মাত্র ৩৭১টিতে। দীর্ঘদিন ধরেই গেটম্যান নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে আছে। পাশাপাশি লেভেলক্রসিংগুলোতে দীর্ঘ চার দশকেও জুতসই অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে না রেলওয়ে। ফলে প্রাণহানির ঘটনা দিন দিন বাড়ছে।
জানা গেছে, পাশের দেশ ভারতে লেভেলক্রসিংয়ে যাত্রী নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা বসানো হয়েছে। লেভেলক্রসিংগুলোতে দুর্ঘটনা কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রেল রোড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফআরএ) গুগল ম্যাপের শরণ নিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ রেলওয়ে এসব বিষয়ে বরাবরই নির্লিপ্ত। দিনে দিনে মৃত্যুফাঁদ হয়ে ওঠা লেভেলক্রসিংগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তির সতর্কতা সংকেত স্থাপনের উদ্যোগটুকুও নেই।
রেলওয়ের মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা গেটম্যান নিয়োগ করতে চাইলেও মামলার কারণে প্রক্রিয়াটি আটকে আছে।’
রাজধানীর কুড়িলে রেলপথের পাশে দেয়াল তোলা হয়েছে। প্রত্যাহার করা হয়েছে এখানকার গেটম্যানদের। কিন্তু রেললাইনের এই পথে অসংখ্য পথচারীর পারাপার থেমে নেই। তারা এখানে রেললাইন পার হচ্ছে জীবন হাতে নিয়ে।
স্থানীয় বাসিন্দা আকমল আলী বলেন, ‘কুড়িল, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, নর্দ্দাসহ আশপাশের বাসিন্দাদের বড় একটি অংশকে এই রেলপথ পার হয়ে কুড়িল বিশ্বরোড বাস স্টপেজ থেকে বাসে উঠতে হয়। আবার অনেকে বিশ্বরোডে বাস থেকে নেমে রেললাইন পার হয়ে এপারে আসে। অথচ এখানে চোখের পলকে ট্রেন চলে আসে। আর তার মধ্যেই বিরামহীন রেললাইন পার হচ্ছে মানুষ। ফলে ট্রেনে কাটা পড়ে মানুষের প্রাণহানি বা পঙ্গু হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে প্রায়ই।’
রাজধানীর খিলগাঁও, মালিবাগ, বনানী, নাখালপাড়া, তেজগাঁওসহ বিভিন্ন স্থানে রেলপথ পার হতে হয় নিজ দায়িত্বে। কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে রেলপথের পাশে ভাসমান বাজার বসার ঘটনা তো দীর্ঘদিনের।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শক্তিশালী আলো ও শব্দসহযোগে সতর্কতা সংকেত ব্যবস্থাপনা কোনো লেভেলক্রসিংয়েই করা হয়নি। লেভেলক্রসিংয়ের ওপর দিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের রাস্তাই বেশি। অন্যান্য সংস্থাও রাস্তা তৈরি করেছে। এ ক্ষেত্রে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়ার দরকার। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ অবৈধ লেভেলক্রসিংগুলো বন্ধ করতে পারত। কেন করছে না সেটা একটা প্রশ্ন।’
বাংলাদেশ রেলওয়ের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকায় রেলপথে ৩৫টি বৈধ লেভেলক্রসিং আছে। প্রতিটি ক্রসিং অতিক্রম করার সময় সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ করে দিতে হয়। প্রতিটি ক্রসিংয়ে দিনে কমপক্ষে সাত মিনিট করে ১১৪ বার বন্ধ রাখতে হয় যান চলাচল। কর্মঘণ্টা ও জ্বালানির অপচয় এড়াতে সব লেভেলক্রসিংয়ে ফ্লাইওভার নির্মাণ করা যেত, কিন্তু তা করা হয়নি।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, ‘মাটির একই তলে সড়ক ও রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে শুরু থেকেই। দুর্ঘটনা এড়াতে নিচে রেল আর ওপরে সড়ক যান চলাচলের ব্যবস্থা করা যায়। নতুন প্রকল্পে লেভেলক্রসিংয়ে এ ধরনের অবকাঠামো রাখা উচিত।
সুত্র:কালের কন্ঠ, ২৮ মার্চ, ২০১৮