শিরোনাম

রেলের উন্নয়নে বড় বাধা দুর্নীতি

রেলের উন্নয়নে বড় বাধা দুর্নীতি

মনজু আরা বেগম :দেশের সার্বিক উন্নয়নে রেলের ভূমিকা অপরিসীম। পৃথিবীর জনসংখ্যাবহুল দেশগুলোয় রেলপথ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। কিন্তু আমাদের দেশে রেলপথ সে স্থানটি দখল করতে পাচ্ছে না; বরং এটি এখন লোকসানি খাত হিসাবে সর্বত্র বিবেচিত হচ্ছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান। ১৫ নভেম্বর ১৮৬২ সালে ব্রিটিশ আমলে এর জন্ম। স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশে অনেক খাতের উন্নয়ন ঘটলেও এ খাতটির কোনো উন্নয়ন হচ্ছে না। অথচ দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে রেলের গুরুত্ব অপরিসীম। যোগাযোগব্যবস্থার মধ্যে রেল সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত হলেও এটি একটি অবহেলিত খাত হিসাবেই এ দেশে রূপ নিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে অধিকাংশ রেল এবং রেলস্টেশনগুলো জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে থাকলেও এগুলো যথাযথ সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। লোকবলের অভাবে বেশকিছু স্টেশন ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। জানা যায়, এক টাকা আয় করতে রেলের ব্যয় হয় ৬ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে রেল আয় করেছে ১ হাজার ১৩ কোটি টাকা; কিন্তু এ সময় ব্যয় করতে হয়েছে ৬ হাজার ২৫ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরেও রেল ১ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা আয় করতে ব্যয় করেছে ৫ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা (যুগান্তর, ২৩.০১.২২)। এভাবে প্রতিবছরই বিপুল অঙ্কের অর্থ লোকসান দিয়ে রেল চলছে। তারপর সেবার মানেও কোনো উন্নতি নেই।

উত্তরবঙ্গের লালমনিরহাট জেলা ৫টি উপজেলা নিয়ে গঠিত। এখানে একটি রেলওয়ে জংশন আছে। এখান থেকে বুড়িমারী স্থলবন্দর পর্যন্ত এ রুটকে বলা হয় বিডিআর (বেঙ্গল ডুয়ার্স রেলওয়ে) লাইন। বুড়িমারী থেকে লালমনিরহাট জেলার দূরত্ব ৯০ কিলেমিটার। এ রুটে ট্রেন কখন আসে আর কখন যায়, তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। বুড়িমারী স্থলবন্দর হওয়ার কারণে যদিও এ রুটের গুরুত্ব অনেকটাই বেড়ে যাওয়ার কথা; কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। অথচ বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে ভারত, ভুটান ও নেপাল থেকে কয়লা, কাঠ, টিম্বার, পাথর, সিমেন্ট, চায়না ক্লে, কোয়ার্টজ, রাসায়নিক সার, গরু, কসমেটিকস-সামগ্রী, পশুখাদ্য, ফলমূল, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, চাল, ডাল, গম, বিভিন্ন ধরনের বীজ, তামাক ডাঁটা প্রভৃতি পণ্যসামগ্রী আমদানি করা হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা হয় ইলিশ, মেলামাইনের তৈরি বাসনপত্র, ওষুধ, শাড়ি, কাপড়সহ বিভিন্ন সামগ্রী। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বুড়িমারী স্থলবন্দর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। যোগাযোগব্যবস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল প্রভৃতিসহ বিভিন্ন দিক থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অনুন্নত এলাকা সম্ভবত এটাই।

অনুন্নত ও পিছিয়ে পড়ার কারণে এ এলাকার অধিকাংশ মানুষই আর্থিক দিক থেকে সাশ্রয়ী, নিশ্চিত ও নিরাপদ ভ্রমণের জন্য এবং যানজটের কবল থেকে রক্ষা পাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে রেলে ভ্রমণ করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এখানে যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে বাস সার্ভিস চালু থাকলেও লাগেজ বা মালামাল নিয়ে বাসে ভ্রমণের ঝক্কি-ঝামেলা অনেক এবং ভাড়াও রেলের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। সড়কের চেয়ে রেলে দুর্ঘটনা অপেক্ষাকৃত কম হওয়ায় মানুষ রেল ভ্রমণেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে বেশি। এছাড়া তুলনামূলকভাবে রেলের ভ্রমণ বাসের চেয়ে আরামদায়ক। তাই এ এলাকার অধিকাংশ মানুষ, বিশেষ করে দরিদ্র ও নিু মধ্যবিত্ত শ্রেণি রেলের ওপর নির্ভরশীল। বুড়িমারী থেকে লালমনিরহাটে যাওয়ার লোকাল ট্রেনের ভাড়া ২০ টাকা, কমিউটারের ভাড়া ৩০ টাকা এবং আন্তঃনগর ট্রেনের ভাড়া ৫০ টাকা। পাশাপাশি বুড়িমারী থেকে লালমনিরহাটের বাসভাড়া ১২০ টাকা। বুড়িমারী স্থলবন্দর থেকে উত্তরবঙ্গের দিনাজপুরসহ অনেক স্থানে সরাসরি যাওয়ার কোনো ট্রেন নেই। এ কারণে বুড়িমারী থেকে সরাসরি ঢাকা যাওয়ার জন্য একটি আন্তঃনগর ট্রেন অত্যন্ত জরুরি।

বর্তমানে লালমনিরহাট থেকে ঢাকা রুটে ‘লালমনি এক্সপ্রেস’ নামে একটি ট্রেন চলছে। কিন্তু বুড়িমারী থেকে লালমনিরহাট পর্যন্ত বিডিআর লাইনের যাত্রীরা এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। লালমনিরহাটে গিয়ে যাত্রাবিরতি করতে হয়। এ নিয়ে বহুদিন ধরে এলাকাবাসী বহু আবেদন-নিবেদন করলেও কোনো লাভ হচ্ছে না। উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ১১ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলায় এক জনসভায় বুড়িমারী-ঢাকা রুটে একটি আন্তঃনগর ট্রেন ‘তিনবিঘা এক্সপ্রেস’ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এর প্রায় এক বছর পর ২০১২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর লালমনিরহাট সদরে কালেক্টরেট মাঠে এক জনসভায় আবার তিনি এ প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। এরপর ২০১৮ সালের ১১ জানুয়ারি তৎকালীন রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন। ২০১৯ সালের ২২ মার্চ বর্তমান রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন তিনবিঘা এক্সপ্রেস দ্রুত চালুর আশ্বাস দেন। সর্বশেষ গত বছরের ১৩ নভেম্বর রেলমন্ত্রী আবারও একই আশ্বাস দেন। আশ্বাস আর প্রতিশ্রুতির শেষ হচ্ছে না। দুর্ভাগ্য অবহেলিত এ এলাকার মানুষের। আশ্বাসের বাণী শুনতে শুনতে ২০১১ থেকে ২০২২ চলে এলো, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি আর বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর লালমনিরহাট জেলা নাগরিক অধিকার ফোরাম লালমনিরহাট সচেতন সমাজ উন্নয়ন সংস্থার ব্যানারে রেলওয়ে চত্বরে এক মানববন্ধনও করেছিল এবং ডিভিশনাল রেলওয়ে ম্যানেজার বরাবর একটি স্মারকলিপি দিয়েছিল। জানা যায়, অদ্যাবধি এর জবাব পাওয়া যায়নি। শুধু তাই নয়, বর্তমান সংসদ-সদস্য ও সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন সংসদে বিষয়টি তুলে ধরেছিলেন এবং ওই এলাকার জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন, যার বাড়ি হাতীবান্ধা উপজেলার বড়খাতায়। কিন্তু এ ১১ বছরেও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হলো না।

এখানকার কয়েকটি স্টেশন স্টেশনমাস্টারের অভাবে দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। এসব স্টেশনের স্টেশন মাস্টার অবসর গ্রহণের পর আর কোনো নতুন মাস্টার নিয়োগ বা পোস্টিং না দেওয়ায় এটি বন্ধ ছিল। লোকবলের অভাবে একটি স্টেশন মাত্র একজন স্টেশন মাস্টার দিয়েই চলে। তাকে সহায়তা করার কেউ নেই। স্টেশনগুলোয় সুইপার বা ক্লিনার না থাকায় নোংরা দুর্গন্ধে স্টেশনে দাঁড়ানোর পরিবেশ নেই বললেই চলে। ওয়েটিং রুমগুলোর অবস্থাও তথৈবচ এবং প্রায় সময়ই বন্ধ থাকে। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার উপায় নেই, বিশেষ করে নারী যাত্রীদের। প্রায় প্রতিটি স্টেশনের অবস্থা একই রকম। হাতিবান্ধা ও আদিতমারী উপজেলা হেডকোয়ার্টার হওয়ার পরও এ স্টেশনগুলোর অবস্থাও প্রায় একই রকম। টিকিট ছাড়াই যাত্রীরা অনায়াসে রেল ভ্রমণ করছে। অনেকে টিকিট কেটে ভ্রমণ করতে চাইলেও কাউন্টার বন্ধ থাকায় বিনা টিকিটে ভ্রমণ করতে বাধ্য হয়। এতে সরকার বিরাট অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে এবং হচ্ছে। আবার টিকিট কাটতে হয় না বলে অনেকে বিনা টিকিটে ট্রেনে চড়ে বসে। ফলে যাত্রীর ভিড়ে ট্রেনে ওঠার কোনো উপায় নেই। পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় মার্কা মেয়াদোত্তীর্ণ ট্রেনের ইঞ্জিন ও বগি দিয়েই চলছে রেল। এগুলোর অধিকাংশই বয়সের ভারে ন্যুব্জ। জানা যায়, বর্তমানে ৮৭ শতাংশ ইঞ্জিন ও ৭৭ শতাংশ কোচের আয়ুষ্কাল শেষ। এগুলো চালু রাখার জন্য যন্ত্রাংশ আমদানি করতে হচ্ছে। এছাড়াও সংস্কারবিহীন রেললাইনের কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে।

প্রতিবছর রেলের বরাদ্দ বাড়লেও বাড়ছে না ট্রেনের গতি এবং কাঙ্ক্ষিত সেবার মান। পত্রিকান্তরে জানা যায়, রেলের ৩৯টি উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় হচ্ছে ১ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পগুলো সমাপ্ত হতে এ ব্যয় বেড়ে দাঁড়াবে তিনগুণের বেশি। বাংলাদেশ রেলওয়ের বড় দুটি ওয়ার্কশপের ৮০ শতাংশ যন্ত্রাংশই ব্রিটিশ আমলের, যা অনেক আগেই উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়েছে। অতিরিক্ত যাত্রী বহনের কারণে এখানকার ট্রেনের কোচগুলোয় বসা তো দূরের কথা, দাঁড়ানোর মতো কোনো জায়গা বা অবস্থা নেই। বাথরুমের কথা আর নাইবা বললাম। শুনেছি, এখানকার ট্রেনগুলোয় মাঝে মাঝে যে দু-একজন টিকিট চেকার-কালেক্টর দায়িত্ব পালন করতে আসেন, তারা অবৈধ উপায়ে যাত্রীদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে নিজেদের পকেট ভারী করেন। উন্নয়নের পথে বিরাট বাধা হিসাবে কাজ করছে দুর্নীতিপরায়ণ মানসিকতা। এ এলাকার মানুষ কোনো ঈদ পর্ব ছাড়াই ট্রেনের হাতল ধরে ঝুলে ঝুলে সবসময় যাতায়াত করে। কারও মুখে কোনো অভিযোগ নেই। অভিযোগ করবে কার কাছে? অল্প কয়েকটি বগি দিয়ে প্রতিদিন এত মানুষের যাতায়ত কীভাবে সম্ভব? বগির সংখ্যা বাড়ানো এবং এগুলোর সংস্কার অত্যন্ত জরুরি। রেলওয়ের ওয়ার্কশপগুলোতে নতুন নতুন ইঞ্জিন ও বগি তৈরি, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ তৈরির জন্য স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। এতে একদিকে যেমন আমাদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে, নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে; অন্যদিকে রেল থেকে সরকারের রাজস্ব আয় কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে। রেলকে আর লোকসানের মুখে পড়তে হবে না।

উত্তর জনপদের অবহেলিত মানুষের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন তথা স্বাচ্ছন্দ্যে রেল ভ্রমণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতি ‘তিনবিঘা এক্সপ্রেস’ অবিলম্বে বাস্তবায়ন এবং বর্তমান রেলের বগি সংযোজনসহ সেটআপ অনুযায়ী লোকবল নিয়োগের লক্ষ্যে জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যত দ্রুত এগিয়ে আসবেন, এ অঞ্চলের যাত্রীদের দুর্ভোগ ও কষ্ট তত দ্রুত লাঘব হবে।

মনজু আরা বেগম : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক মহাব্যবস্থাপক, বিসিক

[email protected]

সূত্র:যুগান্তর, ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২


About the Author

RailNewsBD
রেল নিউজ বিডি (Rail News BD) বাংলাদেশের রেলের উপর একটি তথ্য ও সংবাদ ভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল।

Comments are closed.