ইসমাইল আলী: যমুনার তীরে নির্মাণ করা হবে একটি জাদুঘর। এজন্য ব্যয় করা হবে ৩৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। আর জাদুঘরের জন্য সাইট ডেভেলপ, পার্কিং ও ফুটপাত নির্মাণে ব্যয় হবে আরও ছয় কোটি টাকা। আরেকটি পরিদর্শন বাংলো নির্মাণে ব্যয় হবে ছয় কোটি ২৫ লাখ টাকা। এজন্য সাইট ডেভেলপ, পার্কিং ও ফুটপাত নির্মাণে যাবে আরও আড়াই কোটি টাকা। ভ্যাট-শুল্ক মিলিয়ে এ জাদুঘর ও পরিদর্শন বাংলো নির্মাণে মোট ব্যয় হবে ৬৯ কোটি ৭২ লাখ টাকা।
প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানসহ আনুষঙ্গিক খাতের বাজেট ধরা হয়েছে চার কোটি টাকা। এভাবেই অর্থ অপচয়ের বিভিন্ন খাত রয়েছে বঙ্গবন্ধু রেল সেতু নির্মাণ প্রকল্পে। যদিও প্রকল্পটির প্রাথমিক প্রস্তাবে এসব ব্যয় ছিল না। তবে গত মার্চে বঙ্গবন্ধু রেল সেতু নির্মাণ প্রকল্প সংশোধনের সময় নতুন এসব ব্যয়ের খাত যুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পটির গাড়ি কেনা, ভাড়া ও রক্ষণাবেক্ষণে যাবে প্রায় ৯২ কোটি টাকা। আবার বঙ্গবন্ধু রেল সেতু নির্মাণেও কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে অন্যান্য রেল সেতুর কয়েকগুণ।
তথ্যমতে, চার দশমিক ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু রেল সেতুটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি সাত লাখ টাকা। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে এ প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। তবে গত মার্চে প্রকল্পটির ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে মূল সেতু নির্মাণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিমূল্য ১২ হাজার ৯৫০ কোটি ছয় লাখ টাকা। যদিও ডাবল লাইন হওয়ায় সেতুটির দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৬০ কিলোমিটার বিবেচনা করছে রেলওয়ে। এতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে এক হাজার ৩৪৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা।
এদিকে রূপসা নদীর ওপর নির্মাণাধীন রূপসা রেল সেতুর কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে ২৪১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। ভারতের ঋণে (এলওসি) রূপসা রেল সেতু নির্মাণে চুক্তি সই করা হয়েছে ২০১৫ সালের আগস্টে। আর মেঘনা নদীর ওপর নির্মিত দ্বিতীয় ভৈরব রেল সেতুর কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ১৪৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এছাড়া তিতাস নদীর ওপর নির্মিত দ্বিতীয় তিতাস রেল সেতুর কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় মাত্র ৮৩ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এ সেতু দুটি উদ্বোধন করা হয় ২০১৭ সালের নভেম্বরে।
রেলওয়ের এ হিসাবে দেখা যায়, রূপসা রেল সেতুর তুলনায় বঙ্গবন্ধু রেল সেতু নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে পাঁচ দশমিক ৫৯ গুণ। দ্বিতীয় ভৈরব রেল সেতুর তুলনায় এ ব্যয় পড়ছে ৯ গুণের বেশি ও দ্বিতীয় তিতাস সেতুর তুলনায় ১৬ গুণেরও বেশি।
অস্বাভাবিক এ ব্যয়ের পরও বঙ্গবন্ধু রেল সেতু প্রকল্পে অর্থ অপচয়ের নানা আয়োজন রয়েছে, যা শেয়ার বিজের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। এর মধ্যে অন্যতম জাদুঘর ও পরিদর্শন বাংলো নির্মাণ।
প্রকল্পটির আওতায় সাড়ে চার হাজার বর্গমিটারের জাদুঘর নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে প্রতি বর্গমিটারের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৫ হাজার টাকা। এ হিসাবে জাদুঘর নির্মাণে ব্যয় হবে ৩৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। আর এক হাজার ২৫০ বর্গমিটার পরিদর্শন বাংলোয় প্রতি ঘনমিটারের ব্যয় ৫০ হাজার টাকা। এতে নির্মাণে ব্যয় পড়বে ছয় কোটি ২৫ লাখ টাকা। আর জাদুঘর ও পরিদর্শন বাংলোর জন্য সাইট ডেভেলপ, পার্কিং ও ফুটপাত নির্মাণে লামসাম হিসেবে ব্যয় ধরা হয়েছে। এতে দুই খাতে যাবে যথাক্রমে ছয় কোটি ও আড়াই কোটি টাকা।
প্রাথমিকভাবে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সেতুটির নির্মাণকাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু গত মার্চ পর্যন্ত এর অগ্রগতি ছিল মাত্র ১০ শতাংশ। ফলে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর।
এদিকে নির্মাণশেষে আয়োজিত সেতুটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ব্যয় হবে আড়াই কোটি টাকা। আর প্রকল্পটির ডকুমেন্টেশন প্রকাশনা, আর্কাইভের জন্য ডকুমেন্টারি নির্মাণ, জাদুঘরের জন্য সুভ্যেনির প্রকাশনা ইত্যাদি খাতে যাবে ৭৫ লাখ টাকা। এছাড়া প্রকল্পটির জন্য ওয়েবসাইট তৈরি, ডিজিটাইজেশন ও আইটিবিষয়ক অন্যান্য খাতে যাবে আরও ৭৫ লাখ টাকা।
এদিকে প্রকল্পটির আওতায় রেলওয়ের কর্মকর্তাদের জন্য গাড়ি রয়েছে ৬টি। এর মধ্যে একটি বিলাসবহুল স্পোর্টস জিপ, দুটি ডাবল কেবিন পিকআপ, ২টি মাইক্রোবাস ও একটি সাধারণ স্পোর্টস জিপ। নিবন্ধন ফি, ফিটনেস চার্জ, লাইসেন্স ফিসহ এগুলোর দাম ধরা হয়েছে চার কোটি ৪২ লাখ টাকা। আর এসব গাড়ির জ্বালানি বাবদ ব্যয় হবে আড়াই কোটি টাকা। আর মোটরযান রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত ব্যয় আরও ২৭ লাখ টাকা।
এর বাইরে প্রকৌশলীদের জন্য ১২টি স্পোর্টস ইউলিটি ভেহিকল (এসইউভি) তথা বিলাসবহুল গাড়ি ১২টি, ডাবল কেবিন পিকআপ ১৪টি, ১১ আসনের মাইক্রোবাস ৪টি কেনা হবে। এজন্য ব্যয় হবে প্রায় ৪১ কোটি টাকা। এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় হবে আরও ২২ কোটি টাকা। এছাড়া গাড়ি ভাড়ায় ব্যয় আরও হবে তিন কোটি ৬২ লাখ টাকা। দুটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন স্পিডবোট ভাড়া ব্যয় হবে আরও প্রায় আড়াই কোটি টাকা।
এদিকে আরও ২২টি গাড়ি কেনা হবে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলীদের জন্য। এর মধ্যে ১০টি বিলাসবহুল স্পোর্টস জিপ, আটটি ডাবল কেবিন পিকআপ ও ৪টি মাইক্রোবাস। এজন্য ব্যয় হবে ১৮ কোটি ২০ লাখ টাকা। পাশাপাশি ১০ কোটি টাকায় কেনা হবে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন স্পিডবোট।
প্রসঙ্গত, বঙ্গবন্ধু রেল সেতুটি নির্মাণে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) ঋণ দেবে ১২ হাজার ১৪৯ কোটি ২০ লাখ টাকা। বাকি অর্থ সরকারের তহবিল থেকে সরবরাহ করা হবে।
সূত্র:শেয়ার বিজ, অগাস্ট ১৭, ২০২০