শিরোনাম

বন্ধ রেল কারখানা, লাভবান হলো কে?

বন্ধ রেল কারখানা, লাভবান হলো কে?

নাজমুস সালেহী:

২০১৫ সালে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে সৈয়দপুর রেলওয়ে সেতু কারখানা। কারখানাটি শুধু বাংলাদেশ নয়, উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ রেলওয়ে সেতু কারখানা। এত আধুনিক মেশিনপত্র, উন্নত যন্ত্রপাতি আর ব্যাপক উৎপাদনে সক্ষম এমন কার্যকর রেল সেতু কারখানা বিশ্বের অনেক দেশে এখনও নাই। আর আমরা দেড়শ বছর আগে ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া কারখানাটি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েও তা চালু রাখতে পারলাম না! পারলাম না, নাকি ইচ্ছা করে রাখলাম না। তার কিছুটা সমীকরণ মেলানোর চেষ্টা করা হবে আজ। সচেতন পাঠক নিশ্চয়ই রেল নিয়ে অনেক চিন্তার খোরাক পাবেন বলে আশা রাখছি।
১৮৬৫ সালে ব্রিটিশ সরকার সৈয়দপুরে রেলওয়ে যন্ত্র উৎপাদন কারখানার পাশে ১৮ একর জমিতে নির্মাণ করেন সেতু কারখানা। তখন ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ তিন দেশের রেল নেটওয়ার্ক ছিল একই। বিশাল এই রেল ব্যাবস্থাকে স্বনির্ভর করতে ও রেল সেবা নির্বিঘ্ন করতে গড়ে তোলেন বিশাল এই কারখানা। তখন থেকে রেলওয়ের বিভিন্ন ছোট বড় সেতু, ব্রিজ, কালভার্ট সব কিছুই তৈরি হতো এই কারখানায় উৎপাদিত মালামাল দিয়ে। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের মতো বড় বড় সেতু মেরামত করাও হতো এই কারখানার উৎপাদিত যন্ত্রাংশ দিয়ে।
বাংলাদেশ যেহেতু নদী-নালা-খাল বিল আর হাওর বাঁওড়ের দেশ, ব্রিটিশরা বুঝেছিল এদেশে পুরোপুরি রেল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে গেলে বানাতে হবে অনেকগুলো রেলসেতু। তা ছাড়া নদীর ওপর দিয়ে রেল লাইন সম্প্রসারণ সম্ভব নয়। এসব সেতু বানাতে গিয়ে ব্রিটিশরা দেখলো প্রচুর পরিমাণে সেতু তৈরির মালামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে এবং তা রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতে ব্যয় হচ্ছে প্রচুর পরিমাণ অর্থ। তাই তারা সেতু তৈরির মালামাল ও রক্ষাণাবেক্ষণ যন্ত্রাংশ বঙ্গদেশে তৈরির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এবং ১৮৬৫ সালে বর্তমান বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার সৈয়দপুরে ১৮ একর জায়গার ওপর গড়ে তোলে বিশাল এক সেতু কারখানা। ওই মানের ও সক্ষমতার কারখানা সেই সময় ভারত পাকিস্তান এমনকি বিশে^র অনেক দেশেই ছিল না। এখনও নেই।
শুরুতে এ কারখানার কর্মকাণ্ড পরিচালনায় মেশিন শপ, পয়েন্টস অ্যান্ড ক্রসিং শপ ও গার্ডার ইয়ার্ড শপ নামে তিনটি উপ-কারখানায় প্রায় ১ হাজার শ্রমিক কাজ করত। রেলের সেতু বিভাগের সব স্টেশনের প্লাটফর্ম শেডের মালামাল, রেললাইনের পয়েন্ট অ্যান্ড ক্রসিং, ব্রিজ গার্ডার, ট্রলি ও মটরট্রলি মেরামত এবং তৈরি, মোর গার্ডার, পানির ট্যাঙ্ক, ফুটওভার ব্রিজের মালামাল, ট্যাঙ্ক স্টেজিংসহ ১০০ ধরনের মালামাল তৈরি হতো এই কারখানায়। ২০১৫ সাল পর্যন্ত রেলের বিভিন্ন সেতু, কালভার্ট, ব্রিজ এখানকার উৎপাদিত মালামাল দিয়ে যেমন নির্মিত হয়েছে তেমনি দেশের প্রায় দুই হাজার রেল সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা মেরামতও হয়েছে এখানকার উৎপাদিত যন্ত্রপাতি দিয়ে। কারখানায় আছে বিরল সব মেশিনপত্র। এখানকার যন্ত্রপাতি সবগুলোই অত্যাধুনিক। বর্তমান বিশ্বের অনেক রেল সেতু কারখানায় এসব মেশিন এখনও নেই। কারখানার মেশিনগুলো ইংল্যান্ড, জার্মানি, আমেরিকা, জাপান আর ফ্রান্স থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতিটি মেশিনের দাম কয়েক কোটি টাকা করে। কোনো কোনো ভারী মেশিনের দাম আছে কয়েকশ কোটি টাকা পর্যন্ত। ১৮ একর জায়গাজুড়ে এমন মেশিন আছে শতাধিক। ৮০-৯০-এর দশকে এই কারখানা রেলের নিজস্ব চাহিদা পূরণ করে উৎপাদিত মালামাল বাইরেও বিক্রি করত। এতে রেল প্রতিবছর আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছে বেশ।
রেলের গৌরবের সেই ঐতিহ্যবাহী কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে ২০১৫ সালে। নভেম্বরের শুরুতে গিয়েছিলাম দেখতে সেই কারখানা। নিজ চোখে যা দেখেছি তা কল্পনাতীত। স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলাম। আধুনিক মেশিন আর যন্ত্রপাতিতে ভরপুর বিশাল আয়তনের সেই কারখানা যেন এক বনাঞ্চল। ১৮ একর জায়গার পুরোটাই যেন হিংস্র প্রাণীর অভয়ারণ্য। কারখানা বন্ধের পর ৫-৬ বছরে পুরো এলাকাটি পরিত্যক্ত ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।
ওই কারখানার ৩টি উপ-কারখানার মধ্যে প্লাটফর্ম শেড বা নকশা ঘরটি তালাবদ্ধ। ভিতরে আবর্জনার স্তূপ। পাশে মেশিন শেডটির চিত্র একই। পুরো ইয়ার্ডজুড়ে ৩ থেকে ৫ ফুট উচ্চতার জংলি গাছ। পরিছন্নতার অভাবে খোলা আকাশের নিচে মাটির ওপরে অ্যাঙ্গেল রড, স্কয়ার রড, কভার প্লেট, মিটার ও ব্রডগেজ লাইনের সেতুর স্পিয়ার গার্ডার, তিস্তা ও পাকশি হার্ডিঞ্জ সেতুর পরিত্যক্ত লোহা-লক্কড়, রেললাইন, একটি বিকল স্টিম ক্রেনসহ বিভিন্ন ধরনের লোহার মালামাল বিক্ষিপ্তভাবে রাখায় এর ভেতর দিয়ে বেরিয়েছে জংলি গাছ। এভাবে পুরো ইয়ার্ডজুড়ে মাটির নিচে চাপা পড়েছে ফ্রেঞ্চ প্লেট ও কভার প্লেট। যার আনুমানিক বাজার মূল্য অন্তত হাজার কোটি টাকা বলে জানিয়েছে এখানে কর্মরতরা।
শুধু কি তাই! খোলা আকাশের নিচে অবহেলা অযত্নে পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে কয়েক হাজার কোটি টাকা মূল্যের উন্নতমানের মেশিনগুলোও। খোলা আকাশের নিচে পড়ে থেকে স্থায়ীভাবে বিকল হয়ে পড়ছে রেয়ার সেসব যন্ত্রপাতি। পৃথিবীর অনেক দেশে না থাকায় যে মেশিন নিয়ে আমাদের গর্ব করার কথা সেসব মূল্যবান যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে ঘন জঙ্গলে মাটির সঙ্গে মিশে। ফ্রান্স-জার্মানি-ইংল্যান্ড-আমেরিকা রেলওয়ে থেকে এখনও রেল কর্মকর্তারা কারখানাটি পরিদর্শনে আসেন ধারণা নিতে, অথচ সেটি এখন পুরো একটা পরিত্যক্ত ভাগাড়।
সেখানকার পরিস্থিতি দেখে ঘুমুতে পারিনি কয়েকদিন। আহ! রাষ্ট্রীয় সম্পদের কী নিদারুণ অপচয়। কীভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে একটা বিশাল আয়তনের উন্নত কারখানাকে। ১৮ একর জায়গাজুড়ে শতাধিক আধুনিক যন্ত্রপাতি এভাবে নষ্ট হচ্ছে দেখে বেশ কান্না পাচ্ছিল আমার। এই আমার দেশ! একজনও কী দেশপ্রেমিক রেল অফিসার নেই! কেউ কি রেলের ভালো চায় না! কেউ কি এগিয়ে আসবে না এই কারখানাটিকে বাঁচাতে? ইশ! রেল কর্তারা ঘুমান কীভাবে এমন দৃশ্য দেখে?
আরও বেশি মুষড়ে পড়েছিলাম সেখানে মেশিনগুলোর জরাজীর্ণ বেহাল দশা দেখে। বন্ধ হয়ে গেছে ঠিক আছে তাই বলে যত্নও করা হবে না কয়েক হাজার কোটি টাকা মূল্যের সেসব যন্ত্রপাতির! জঙ্গল পরিষ্কার করে মেশিনগুলোকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া যায় না? তাহলে কেন এত অবহেলা? জঙ্গল পরিষ্কার করার লোকবলও কী রেলের নাই? যন্ত্রপাতিগুলো যাতে নষ্ট না হয়ে পড়ে তার প্রাথমিক রক্ষণাবেক্ষণ করার সক্ষমতাও কি নাই?
কারখানাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর রেলের নতুন সেতু নির্মাণ কিংবা বর্তমানে প্রায় দুই হাজার ছোট বড় সেতু রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতে পুরোপুরি বিদেশ নির্ভর হয়ে পড়েছে রেলওয়ে। এতে প্রতিবছর শত কোটি টাকার মালামাল কিনতে হচ্ছে বিদেশ থেকে। অথচ শুধু লোকবলের অভাবে সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও চালু করা যাচ্ছে না রেলওয়ে সেতু কারখানা। আসলেই কী লোকবলের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে? নাকি ইচ্ছা করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে?
যেসব মালামাল এখানে উৎপাদন করা হতো তার সবই এখন বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। মালামালগুলো সরবরাহ করতে বেশ কিছু ঠিকাদার এসে জুটল, তারা নতুন আইটেম সাপ্লাই দিতে নতুন করে রেলের তালিকাভুক্ত হলো। এদের সবগুলোই বিদেশি প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় প্রতিনিধি। যে মাল কারখানাটিতে উৎপাদন খরচ পড়ত ২০ টাকা তা দেশীয় প্রতিনিধির মাধ্যমে বিদেশ থেকে আমদানি করতে খুব স্বাভাবিকভাবেই খরচ হচ্ছে ১০০ টাকা। রেল অফিসাররা কোনো কোনো সময় সেসব মালামাল কিনছেন ইচ্ছেমত বাড়তি দামে। বিদেশি মালের দোহাই দিয়ে অনেক সময় এর দাম উঠছে আকাশ উচ্চতায়। এতে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন সরবরাহকারী ঠিকাদার আর সংশ্লিষ্ট রেল কর্মকর্তারা। যে রেল কর্মকর্তাদের দায়িত্ব ছিল কারখানাটি সচল করার তারা এখন ব্যস্ত বিদেশ থেকে মালামাল ক্রয়ে। প্রতিবছর গড়ে দেড় হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়ে চলা প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন সক্ষমতা থাকার পরও নিজস্ব কারখানা চালু না করে বিদেশনির্ভর থেকে আরও বেশি লোকসানের আয়োজন করে চলেছে।
দেশে কি শিক্ষিত তরুণ লোকবল নাই? দেশের তরুণরা কি বিদেশে সফলতার সঙ্গে কাজ করছে না? দেশে কি দক্ষ শিক্ষিত লোকবলের অভাব? যে দেশে এক-তৃতীয়াংশ তরুণ চাকরির অভাবে বেকার সে দেশে লোকবলের অভাবে একটি ঐতিহ্যবাহী কারখানা বন্ধ হয়ে একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের লোকসান বাড়াতে থাকবে? লোকসান থামাতে কিংবা রেলের চাকা সচল রাখতে সে কারখানাটিতে কাজ করার মতো দেশে একজনও পাওয়া যায়নি? দেশে এত প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়, এত বিজ্ঞানভিত্তিক লেখাপড়া, এত উচ্চশিক্ষা, এত ছেলেমেয়ে বিদেশ যাচ্ছে পড়তে- কারখানায় নিয়োগ দেওয়ার মতো কাউকেই কি পাওয়া যায়নি? একজনও কি নাই কারখানায় কাজ করার মতো যোগ্য লোক? এসবের উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ। তাহলে কেন গৌরবের সেই কারখানা বন্ধ হয়ে গেল? তার উত্তর কী? কে নেবে এর দায়ভার?
এই বছর রেলে বাজেট দেওয়া হয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। এর আগের বছর রেলের বাজেট ছিল ১৬ হাজার কোটি টাকা। গত দশ বছরে রেলের উন্নয়ন বাবদ খরচ হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। এ মুহূর্তে রেলের উন্নয়ন প্রকল্প চলছে ৪৩টি। এসব প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা। এত কোটি টাকার বিশাল বিশাল প্রকল্প, কিন্তু কারখানাটি সচল করার কোনো প্রকল্প নেই কেন? ১০ বছরে এত টাকা খরচ হলো উন্নয়নে, কারখানায় এক টাকাও বরাদ্দ দেওয়া হলো না কেন? কারখানাটির ব্যাপারে রেলের কোনো উদ্যোগ এখনও নেই। কত ধরনের অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে বস্তা বস্তা টাকা ঢালছে রেল অথচ উৎপাদনশীল এই কারখানার প্রতি যেন কোনো নজর নেই।
তার মানে আসলে কারখানাটিকে সচল রাখার চেষ্টায়ই করা হয়নি। এক দিনে তো আর হঠাৎ করে উৎপাদন বন্ধ হয়ে মুখথুবড়ে পড়ে কারখানা দীর্ঘদিন অবহেলায় ধীরে ধীরে করুণ পরিণতি হয়েছে।
এই কারখানা বন্ধের কারণে প্রতিবছর লোকসান দিতে হচ্ছে রেলকে। বিঘ্নিত হচ্ছে রেলের সেবা। বিপদে পড়তে হচ্ছে সময়মতো মালামাল না পাওয়ায়। এত কিছুর পরও কেন সচলের উদ্যোগ নেই? কারখানা বন্ধ হয়ে পড়ে থাকলে কার লাভ? কার ক্ষতি? এসব প্রশ্নের উত্তর মেলানেরা দায়িত্ব দিলাম সচেতন পাঠকদেরই।
গণমাধ্যমকর্মী
সূত্র:সময়ের আলো, ৩ ডিসেম্বর, ২০২১

About the Author

RailNewsBD
রেল নিউজ বিডি (Rail News BD) বাংলাদেশের রেলের উপর একটি তথ্য ও সংবাদ ভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল।

2 Trackbacks & Pingbacks

  1. additional hints
  2. Neotonics official website

Comments are closed.