শিরোনাম

সড়কের তুলনায় রেলের উন্নয়ন বেশি দৃশ্যমান

সড়কের তুলনায় রেলের উন্নয়ন বেশি দৃশ্যমান

সুজিত সাহা:
প্রতি বছর সড়ক ও রেল অবকাঠামোর র‍্যাংকিং করে আসছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ)। র‍্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়ন হলেও অন্যান্য দেশের তুলনায় তা কম। ২০১১-১২ সালে গুণগত মানে দেশের সড়ক অবকাঠামোর অবস্থান ছিল ১৪২টি দেশের মধ্যে ১১১তম। ২০১৭-১৮ সালে স্কোরিংয়ে কিছুটা উন্নতি হলেও অবস্থানে বদল হয়নি। যদিও গত আট-নয় বছরে সড়ক অবকাঠামোয় বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় অর্ধলক্ষ কোটি টাকা।

এ সময়ে সমপরিমাণ বিনিয়োগ হয়েছে রেল অবকাঠামোয়। তবে সড়কের তুলনায় রেল অবকাঠামোর উন্নয়ন তুলনামূলক বেশি দৃশ্যমান। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের র‍্যাংকিংয়ে ২০১১-১২ সালে বাংলাদেশের রেল অবকাঠামোর অবস্থান ছিল ১৪২টি দেশের মধ্যে ৭৩তম। সর্বশেষ ২০১৭-১৮ সালে ১৪০টি দেশের মধ্যে ৬০তম স্থানে চলে এসেছে দেশের রেল অবকাঠামো। এ সময় রেলের সার্বিক স্কোরও ২ দশমিক ৫ থেকে বেড়ে হয়েছে ২ দশমিক ৯৪ (৭-এর মধ্যে)।

যদিও একসময় যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে রেলের চেয়ে সড়কই বেশি গুরুত্ব পায়। সড়কপ্রধান যোগাযোগের অংশ হিসেবে এ খাতে (সড়ক অবকাঠামো) বড় অংকের বিনিয়োগও করা হয়। তবে ২০০৯ সাল থেকে রেলকেও বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। গঠন করা হয় আলাদা মন্ত্রণালয়। এরপর রেলের উন্নয়নে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় করা হয়েছে। একই সময়ে সড়ক অবকাঠামোয় বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ৪৬ হাজার কোটি টাকা।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, সড়কের অনেক বড় প্রকল্প এখনো শেষ হয়নি। এগুলো শেষ হলে অবশ্যই তার সুফল মানুষ পাবে। একই সময়ে রেলওয়েতে ট্র্যাক উন্নয়ন, ডাবল লাইন, ইঞ্জিন, কোচ সংযোজনসহ বেশকিছু কাজ হয়েছে, যেগুলোর সুফল এরই মধ্যে আমরা পাচ্ছি। কিন্তু এ ধরনের প্রকল্পসর্বস্ব উন্নয়ন কখনই টেকসই হতে পারে না। টেকসই উন্নয়নের জন্য দরকার সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনা। গত ১০ বছরে সড়ক ও রেলে বড় অংকের বিনিয়োগ হয়েছে। কিন্তু সমন্বিত, পরিকল্পিত ও দ্রুতগতির অবকাঠামো, যেটা উন্নয়নের মানদণ্ড বলে, সেগুলো হচ্ছে না। টেকসই অবকাঠামো গড়ে উঠছে না। সার্বিকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ যোগাযোগের জন্য যে পরিচ্ছন্ন ও পরিকল্পিত উন্নয়ন করা উচিত, তা হচ্ছে না।

বড় বিনিয়োগে রেলের রুট ও ট্র্যাক উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে রেলের রুট ছিল ২ হাজার ৮৩৫ কিলোমিটার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা ৯৪ কিলোমিটার বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৯২৯ কিলোমিটার। এছাড়া ট্র্যাকের পরিমাণ ৩১৮ কিলোমিটার বেড়ে হয়েছে ৪ হাজার ২৯১ কিলোমিটার। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে কাশিয়ানী থেকে গোপালগঞ্জ পর্যন্ত ৪৪ কিলোমিটারসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় নতুন রেলপথ নির্মাণ হয়েছে। এছাড়া দেশের দীর্ঘদিনের পরিত্যক্ত রেলপথগুলো নতুন করে চালুর কাজ শুরু হয়েছে। ভারতীয় সীমান্ত এলাকার সঙ্গে একসময়ের জনপ্রিয় রেলপথগুলো চালুর মাধ্যমে আন্তঃদেশীয় রেলসেবা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী হয়ে মিয়ানমারের ঘুমদুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের কাজও শুরু করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।

দেশে যানবাহনের সংখ্যা বাড়লেও সে অনুপাতে বাড়েনি সড়কের পরিমাণ। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের হিসাব বলছে, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের আওতাধীন সারা দেশে সড়ক রয়েছে ৮৭৬টি, যার দৈর্ঘ্য ২১ হাজার ৩০২ কিলোমিটার। এর মধ্যে জাতীয় মহাসড়ক ৯৬টি, যার দৈর্ঘ্য ৩ হাজার ৮১২ কিলোমিটার। এছাড়া আঞ্চলিক মহাসড়কের দৈর্ঘ্য ৪ হাজার ২৪৬ ও জেলা সড়ক ১৩ হাজার ২৪২ কিলোমিটার। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের মহাসড়ক উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের (এইচডিএম) তথ্যমতে, দেশের এক-চতুর্থাংশ (২৬ দশমিক ৩২ শতাংশ) সড়ক-মহাসড়ক খারাপ অবস্থায় রয়েছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের নেটওয়ার্কভুক্ত সড়কের পরিমাণ ২১ হাজার ৪৮১ কিলোমিটার। সরকারি হিসাবেই বর্তমানে দেশে সাড়ে ৫ হাজার কিলোমিটার সড়ক ভাঙাচোরা দশায় রয়েছে। ‘ইন্টারন্যাশনাল রাফনেস ইনডেক্স’ বা আইআরআই সূচক অনুযায়ী, সারা দেশে প্রায় ১৮ হাজার কিলোমিটার সড়কে জরিপ করে ভাঙাচোরা সড়ক পরিমাপ করেছে এইচডিএম। যদিও গত নয় বছরে নতুন সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ ও উন্নয়নে ৪৬ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে।

বড় বিনিয়োগের ফলে রেলের ট্রিপ ও ট্রেনের সংখ্যা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। এক দশকে রেলের দুই অঞ্চল মিলিয়ে দৈনিক ট্রেনের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩৫০টি। এর মধ্যে আন্তঃনগর ট্রেন ৮৭টি, লোকাল-মিক্সড-পিঅ্যান্ডভি ১২৬টি, মেইল এক্সপ্রেস-কমিউটার-ডেমু ১৩২টি ও আন্তঃদেশীয় ট্রেন মৈত্রী ও বন্ধন এক্সপ্রেস (বাংলাদেশ থেকে পাঁচদিন ও ভারত থেকে পাঁচদিন) চালু আছে পাঁচটি। এর মধ্যে এক দশকের ব্যবধানে রংপুর এক্সপ্রেস, ধূমকেতু, সিরাজগঞ্জ, মৈত্রী, বন্ধন, কালুখালি-ভাটিয়াপাড়া, ফরিদপুর, সোনার বাংলা, কালনী, চট্টলা, মোহনগঞ্জ, বিজয়, হাওড়, কিশোরগঞ্জ, ধলেশ্বরী, টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেস নামের নতুন ট্রেন চালু করেছে রেলওয়ে।

ট্রেন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে যাত্রী পরিবহনের সংখ্যাও। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে রেলপথে যাত্রী পরিবহন হয়েছিল সাড়ে ছয় কোটি। রেলের প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা বেড়ে হয়েছে ৭ কোটি ৭৮ লাখ। এরই মধ্যে রেলের যাত্রী পরিবহন সক্ষমতা ৯ কোটিতে উন্নীত হয়েছে।

তবে গতির উন্নয়নে সাফল্য দেখাতে পারে রেল ও সড়ক— দুই খাতই। রেলপথের আধুনিকায়ন ও নতুন কোচ যুক্ত হলেও ট্রেনের গতি সেভাবে বাড়েনি। রেলপথে ঢাকায় পণ্যবাহী ট্রেন যেতে সময় লাগে এখনো ১৫-২০ ঘণ্টা। সেভাবে গতি বাড়েনি যাত্রীবাহী ট্রেনেরও। ২০০০ সালের দিকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে (সিঙ্গেল লাইনে) ৫ ঘণ্টার কম সময়ে পৌঁছানো গেলেও বর্তমানে ডাবল লাইন রুটেও (৩২১ কিলোমিটারের মধ্যে ২৪৯ কিলোমিটার ডাবল লাইন) বিরতিহীন ট্রেনে পৌঁছতে সময় লাগে সাড়ে ৫ ঘণ্টা। নতুন স্থাপিত রেল ট্র্যাক বা পুনর্বাসনকৃত ট্র্যাকে (মিটার গেজ) ৭৫ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচলের কথা থাকলেও গড়ে ৬০ কিলোমিটারের বেশি গতিবেগে চলতে পারছে না ট্রেন।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) আবুল কালাম আজাদ বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশের যোগাযোগ অবকাঠামোয় রেলপথের গুরুত্ব অপরিসীম। রেলের ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পগুলোর সিংহভাগই এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এছাড়া লোকবল সংকট, কোচ ও ইঞ্জিনের স্বল্পতায় অবকাঠামো উন্নয়নের প্রকৃত সুফল পাওয়া এখনো শুরু হয়নি। দেশের রেল অবকাঠামোর মূল পথ ঢাকা-চট্টগ্রাম ও দুয়েকটি রেলপথ। পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ, ঢাকা-ভাঙ্গা-পায়রাসহ একাধিক বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের পর কোচ-ইঞ্জিন ও লোকবল সংকট দূর করা হলে যেকোনো বিচারে বাংলাদেশ রেলওয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ভালোভাবেই দৃশ্যমান হবে।

এদিকে যে হারে যানবাহন বাড়ছে, সে হারে সড়ক বাড়ছে না। উন্নত হচ্ছে না সড়ক অবকাঠামোও। এর বাইরে সড়কের পাশে হাটবাজার, টোল প্লাজার কার্যক্রমে ধীরগতি মহাসড়কে যানবাহনের গতি কমিয়ে দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় সড়ক গবেষণাগারের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, গত এক যুগে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে সব ধরনের যানবাহনের গতি কমেছে ঘণ্টায় গড়ে ছয় কিলোমিটার। ২০০৪-০৫ সালে দেশের মহাসড়কে সব ধরনের যানবাহনের গড় গতি ছিল ঘণ্টায় ৩৪ দশমিক ৬৩ কিলোমিটার। বর্তমানে তা ঘণ্টায় ২৮ দশমিক ৫৪ কিলোমিটারে নেমে এসেছে।

ধীরগতিসহ অনুন্নত অবকাঠামোয় অস্বস্তি বেড়েছে সড়কপথের যাত্রায়। বিপরীতে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক ট্রেন সার্ভিস চালু হওয়ায় রেল ভ্রমণে আগের তুলনায় স্বাচ্ছন্দ্য পাচ্ছেন যাত্রীরা। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে রেলপথের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শ্রেণীতে ভ্রমণ করেছিলেন ৩৪ হাজার যাত্রী। ২০১৬-১৭ অর্থবছর তা বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৬৮ হাজার। ২০০৭-০৮ মৌসুমে ৩ লাখ ৩৪ হাজার যাত্রী প্রথম শ্রেণীর কোচে চলাচল করলেও ২০১৬-১৭ মৌসুমে ভ্রমণ করেছেন ৬ লাখ ৬৪ হাজার যাত্রী। এছাড়া বিরতিহীন ট্রেন সার্ভিস, ট্রেন ট্র্যাকিং সিস্টেম ছাড়াও নানাবিধ প্রযুক্তিগত উন্নয়ন রেলপথের সেবার মানকে আরো বেশি উন্নত করেছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের সাবেক মহাপরিচালক তাফাজ্জল হোসেন মনে করেন, একটি পরিপূর্ণ রেলসেবার প্রধান শর্ত হচ্ছে একজন যাত্রীকে স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ বাহনে চড়িয়ে দ্রুত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়া। সরকার রেলের উন্নয়নে প্রতি বছর গড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় করছে। কিন্তু কোচ ও ইঞ্জিন সংকট ছাড়াও জনবল ঘাটতির কারণে এসবের সুফল পূর্ণাঙ্গভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। রেল বিশেষায়িত খাত হওয়ায় এখানকার জনবল কাজের মধ্য দিয়েই দক্ষ হয়ে ওঠে। ঘাটতি জনবল দিয়ে হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেও প্রকৃত সুফল পাওয়া যাবে না। পাশাপাশি সারা দেশের রেল যোগাযোগ ঢাকার সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেও মাত্র দুটি লাইনের মাধ্যমে এ বিপুল কর্মযজ্ঞ সামাল দেয়া হয়, যা রেলে বিপুল বিনিয়োগেও ব্যর্থতার পাল্লা ভারী করে। তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে ঢাকা-টঙ্গী-জয়দেবপুর পর্যন্ত তৃতীয় ও চতুর্থ লাইন নির্মাণ জরুরি।

নতুন নতুন ট্রেন সার্ভিস ও টিকিটের মূল্যবৃদ্ধির ফলে রেলের আয়ও বেড়েছে লক্ষণীয়। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে রেলের আয় হয়েছিল ৫৬২ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা বেড়ে হয় ১ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক দশকে রেলের আয় বেড়েছে ৯২৪ কোটি টাকা। তার পরও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা লোকসান দেয় রেলওয়ে। সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রেলের লোকসানের পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।

সুত্র:বণিক বার্তা, জানুয়ারি ১৯, ২০১৯


About the Author

RailNewsBD
রেল নিউজ বিডি (Rail News BD) বাংলাদেশের রেলের উপর একটি তথ্য ও সংবাদ ভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল।

Comments are closed.