শিরোনাম

৪৭৭% ব্যয় বৃদ্ধির পরও কাজ করছে না ভারতীয় ঠিকাদার

৪৭৭% ব্যয় বৃদ্ধির পরও কাজ করছে না ভারতীয় ঠিকাদার

ইসমাইল আলী: মৌলভীবাজারের কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ পুনর্বাসন প্রকল্প নেয়া হয় ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে। তবে সোয়া ১০ বছরে কাজ হয়েছে মাত্র ২৪ শতাংশ। যদিও প্রকল্প ব্যয় বেড়ে গেছে প্রায় ৪৭৭ শতাংশ। এরপরও কাজ করছে না ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কালিন্দি রেল নির্মাণ কোম্পানি।

২০২০ সালে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর প্রায় দুই বছর ধরে বন্ধ রয়েছে প্রকল্পটির কাজ। এর মধ্যে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে। সব মিলে ঝুলে গেছে কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ পুনর্বাসন প্রকল্পটি। ভারতীয় দূতাবাসে কয়েক দফা অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার পাচ্ছে না রেলওয়ে। তাই প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা।

গতকাল প্রকল্পটির প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটির (পিএসসি) বৈঠকে এসব তথ্য উঠে আসে। এতে জানানো হয়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কয়েক দফা চিঠি দিলেও তারা কাজ শুরু করেনি। এর মধ্যে চুক্তি বাতিলের জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে শোকজও করা হয়েছে। তখন তারা কাজ শুরুর আশ্বাস দিলেও তা রাখেনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি প্রতিকারে রেলপথ মন্ত্রণালয়, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ও ভারতীয় দূতাবাসের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক আহ্বানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

তথ্যমতে, ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ পুনর্বাসন প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ১১৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। তবে ২০১৫ সালের মে মাসে তা সংশোধন করা হয়। এতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৬৭৮ কোটি ৫১ লাখ টাকা। অর্থাৎ ব্যয় বেড়ে গেছে ৫৬০ কোটি ৮২ লাখ টাকা বা ৪৭৬ দশমিক ৫২ শতাংশ। ভারতের ঋণে (এলওসি) প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ করা হয় ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর।

প্রকল্পটির আওতায় কুলাউড়া রেলওয়ে স্টেশন থেকে শাহবাজপুর জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ৪৪ দশমিক ৭৭ কিলোমিটার মেইন লাইন ও সাত দশমিক ৭৭ কিলোমিটার লুপ লাইন মিলে মোট ৫২ দশমিক ৫৪ কিলোমিটার রেলপথ ডুয়েলগেজে রূপান্তর করা হবে। এ ছাড়া রয়েছে ছয়টি স্টেশন ও ৫৯টি সেতু-কালভার্ট নির্মাণ। প্রাথমিকভাবে সোয়া এক বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০১২ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পটি শেষ করার কথা ছিল। পরে তা তিন দফা বাড়িয়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে। তবে প্রকল্পটির কাজ হয়েছে ২৪ দশমিক ৪০ শতাংশ।

এদিকে প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে প্রাথমিকভাবে নিয়োগ করা হয়েছিল ভারতের বালাজি রেলরোড সিস্টেমস কোম্পানিকে। তবে ২০২০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর চুক্তি শেষ হওয়ার পর কোম্পানিটি তা নবায়নে রাজি হয়নি। এর পরিপ্রেক্ষিতে নতুন করে পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।

যদিও আপাতত প্রকল্পটির কাজ শুরুর কোনো সম্ভাবনা নেই বলে মনে করেন রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি যে দরে কাজ নিয়েছিল কয়েক বছরে তা অনেক বেড়ে গেছে। যেমন, ৭৪ হাজার টাকার সিøপারের দাম হয়ে গেছে এক লাখ ৪১ হাজার টাকা, আট হাজার টাকার রেলের দাম হয়ে গেছে ১৪ হাজার টাকা। এতে কোম্পানিটি বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়বে। তাই কাজ শুরু করতে গড়িমসি করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

তিনি আরও বলেন, এখন চুক্তি বাতিল করে নতুন ঠিকাদার নিয়োগ করা হলে প্রকল্প ব্যয় দ্বিগুণ হয়ে যাবে। এর দায়ভার মূলত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের। কারণ তারা কাজটি পাওয়ার পর তা দ্রুত বাস্তবায়ন করলে চুক্তি অনুযায়ী ২০১৯ সালের মধ্যে শেষ করা যেত। তবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তা করেনি। তাই চুক্তি বাতিলের পাশাপাশি কালিন্দি রেলের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করা উচিত।

গতকাল অনুষ্ঠিত পিএসসি বৈঠকে জানানো হয়, বর্তমানে প্রকল্পটির শাহবাজপুর, মুড়াউল, বড়লেখা, কাঁঠালতলী ও দক্ষিণভাগ স্টেশনের নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে। এছাড়া ১১টি মাইনর সেতু ও ছয়টি মেজর সেতুর পাইলিং বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে প্রকল্পটির ২৩ জন কি-এক্সপার্টের মধ্যে মাত্র দুজন ও সাপোর্টিং স্টাফের ১২ জনের তিনজন ও অন্যান্য ১০ জন কর্মরত আছেন। আর ১৬৯টি যন্ত্রপাতির মধ্যে মাত্র ১৮টি রয়েছে প্রকল্প এলাকায়।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ২০১৯ সালের ১০ মার্চ ওয়ার্ক প্রোগ্রাম দাখিল করেছিল। সে অনুযায়ী ২০২২ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শেষ করার কথা ছিল। তবে করোনার শুরুর পর প্রকল্পটির কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীকালে তাদের সংশোধিত ওয়ার্ক প্রোগ্রাম দাখিল করতে বললেও প্রতিষ্ঠানটি তা করেনি।

২০২১ সালের ১ এপ্রিল পিএসসি সভায় প্রকল্পটির অগ্রগতি নি¤œ হওয়ায় গতি বৃদ্ধির জন্য ইআরডির মাধ্যমে ভারতীয় হাইকমিশনারের মাধ্যমে ঠিকাদারকে চিঠি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সে অনুযায়ী গত বছর ৬ মে ও ১৭ অক্টোবর দুই দফা চিঠি দেয়া হয়। এরপর ২ মে ভারতীয় হাইকমিশনের মাধ্যমে ঠিকাদারকে চিঠি দেয়া হয়। এ ছাড়া ২৩ সেপ্টেম্বর বহুপাক্ষিক বৈঠকে দৃশ্যমান কাজ শুরুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

এদিকে ২৭ অক্টোবর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কালিন্দি রেল নির্মাণ কোম্পানি কাজ বন্ধ রাখায় তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। এছাড়া ৯ নভেম্বর ভারতের এক্সিম ব্যাংকের ঢাকা অফিসে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ভারতের দূতাবাসের রেলওয়ে বিষয়ক পরামর্শক প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতির বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা করা হয়।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৫ নভেম্বর কালিন্দি রেল নির্মাণের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) প্রকল্প পরিচালককে ও ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত সভায় যথাসময়ে কাজ বাস্তবায়নের বিষয়ে পরিকল্পনার কথা ব্যক্ত করেন। তবে কাজ শুরু না করায় ১৮ নভেম্বর ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা কেন গ্রহণ করা হবে না, তার ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। ২৪ নভেম্বর জবাব দেয় কোম্পানিটি। তবে কোম্পানি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করার অনুরোধ করে। এরপরও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করেনি।

যদিও ২৮ নভেম্বর চুক্তি বাতিল ও কালিন্দি রেল নির্মাণের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, সে প্রসঙ্গে আবার চিঠি দেয়া হয়। এরপর ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত বহুপক্ষীয় বৈঠকে কাজের অগ্রগতি বিবেচনার জন্য ৩০ দিনের সময় দেয়া হয়। কাজ শুরু না করায় পরে গত ২১ ডিসেম্বর, ৩১ ডিসেম্বর ও চলতি বছর ৭ জানুয়ারি ইমেইলের মাধ্যমে সবাইকে বিষয়টি অবহিত করা হয়।

১০ জানুয়ারি এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে কোম্পানিটিকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দেয়া হয়। তবে তারা এর মধ্যে কাজ শুরু না করার চুক্তি বাতিলের বিষয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক মো. সুলতান আলী বলেন, ৩১ জানুয়ারির মধ্যে কাজ শুরু না করায় ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পিএসসি বৈঠকে প্রকল্পটির বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। এ সময় চুক্তি বাতিলের আগে রেলপথ মন্ত্রণালয়, ইআরডি ও ভারতীয় দূতাবাসের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক আহ্বানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বৈঠকের পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

প্রসঙ্গত, ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৯৬ সালের ৪ ডিসেম্বর চালু হয় কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথটি। এটি ভারতের আসাম রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এরপর কুলাউড়া-শাহবাজপুর পর্যন্ত লাতুর ট্রেন নামে একটি ট্রেন চলাচল করত। তবে বাজেট স্বল্পতার কারণে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ না করায় একসময় ট্রেন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে রেলপথটি।

লক্কড়ঝক্কড় রেললাইনে ঘনঘন রেল দুর্ঘটনা ও রেলপথটি চলাচলের অনুপোযোগী বলে কারণ দেখিয়ে ২০০২ সালের ৭ জুলাই তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে বন্ধ করে দেয়া হয় দীর্ঘ ১০৬ বছর চালু থাকা এ রেলপথটি। বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর রেলের সম্পত্তি বেদখল হয়ে যায়। যদিও পণ্য পরিবহন এবং আঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়াতে ২০১০ সালের পর ভারত ও বাংলাদেশ বন্ধ লাইনটি চালুর উদ্যোগ নেয়।

 

সূত্র:শেয়ার বিজ, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২২

About the Author

RailNewsBD
রেল নিউজ বিডি (Rail News BD) বাংলাদেশের রেলের উপর একটি তথ্য ও সংবাদ ভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল।

Comments are closed.