শিরোনাম

অব্যবহৃত রেখেই মেয়াদ শেষ!

অব্যবহৃত রেখেই মেয়াদ শেষ!

জেসমিন মলি ও শামীম রাহমান ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের সংস্কার’ প্রকল্পের অধীনে সংস্থাটিতে এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং (ইআরপি) ব্যবস্থা স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয় ২০০৯ সালে। এজন্য প্রায় ৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা হয় ইআরপির হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার। প্রকল্পটি শেষ হয়েছে গত জুনে। যদিও এখনো ইআরপি ব্যবস্থা চালু করতে পারেনি রেলওয়ে। অব্যবহৃত অবস্থাতেই মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে ইআরপির জন্য কেনা হার্ডওয়্যার। ইআরপি সফটওয়্যারের লাইসেন্সেরও মেয়াদ শেষ হয়েছে চার বছর আগে।

মূলত রেলওয়ের টিকিট বিক্রি, আয়-ব্যয়, ইঞ্জিন-কোচ চলাচল, জ্বালানি ব্যবহার, কর্মীদের দৈনন্দিন কর্মঘণ্টা, ওভারটাইম ইত্যাদি বিষয় পর্যবেক্ষণের জন্য এ উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের অধীনে ইআরপির জন্য বাংলাদেশের স্পেকট্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কনসোর্টিয়াম লিমিটেডের কাছ থেকে দুই লটে কম্পিউটার হার্ডওয়্যার সরঞ্জাম কেনা হয়েছিল। এতে খরচ পড়েছিল ৫১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। ৩০ কোটি ৬২ লাখ টাকায় কম্পিউটার সফটওয়্যার ও লাইসেন্স কেনা হয়েছিল ভারতের টাটা কনসালট্যান্সি সার্ভিসেস লিমিটেডের কাছ থেকে। এসব হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার ব্যবহারের জন্য পরামর্শক বাবদ ব্যয় হয়েছিল আরো প্রায় ৭ কোটি টাকা।

জানা গেছে, ইআরপির জন্য কেনা এসব কম্পিউটার হার্ডওয়্যারের ওয়ারেন্টির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৪ সালের ৩০ জুলাই। সফটওয়্যারের লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৫ সালের মে মাসে। এছাড়া ইআরপি ব্যবস্থায় যেসব তথ্য প্রবেশ (ইনপুট) করানো হয়েছে, সেগুলো অপর্যাপ্ত ও রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পুরনো বেতন কাঠামো অনুযায়ী। ইআরপির জন্য ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক স্থাপনের কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত সেটি হয়নি। এ ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য রেলওয়ের যে পরিবেশ তৈরি করা দরকার ছিল, সেটিও হয়নি। হয়নি স্টোরেজ সার্ভারের কাজও। ইআরপি ব্যবস্থার জন্য দেশের ৫৬টি স্টেশনে মাল্টিপ্লেক্সার বা মাক্স যন্ত্র বসানো হয়েছিল। বর্তমানে ৫৪টি মাক্সই অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে।

গত পাঁচ বছরে মোট ৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকার লোকসান গুনেছে রেলওয়ে। সংস্থাটির আয়-ব্যয়ের মধ্যে রয়ে গেছে বড় পার্থক্য। সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছরেও প্রতি ১০০ টাকা আয় করতে গিয়ে ১৯৬ টাকার বেশি ব্যয় করেছে সংস্থাটি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত পরিচালন অদক্ষতার কারণে লোকসান থেকে বের হতে পারছে না রেলওয়ে।

সম্পূর্ণ ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে বাংলাদেশ রেলওয়ের পরিচালন দক্ষতা বাড়ানোর উদ্দেশ্য থেকে প্রকল্পটি অনুমোদন দিয়েছিল সরকার। কিন্তু এ প্রকল্পের আওতায় কেনা হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারগুলো কাজে লাগার সম্ভাবনা খুবই কম বলে জানিয়েছেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তাদের ভাষ্যমতে, মেয়াদোত্তীর্ণ হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারগুলো সচল রাখতে হলে সেগুলোর পেছনে মোটা অংকের টাকা খরচ করতে হবে। এসব সরঞ্জাম ছিল ১০ বছর আগের। গত ১০ বছরে রেলের কার্যক্রম অনেকটাই বদলে গেছে। ট্রেন ও কোচের সংখ্যায় যেমন রদবদল হয়েছে, তেমনি বেড়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনও। উন্নয়ন ঘটেছে রেলওয়ের পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থায়ও। ফলে ১০ বছর আগের বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে যেসব সরঞ্জাম কেনা হয়েছিল, বর্তমানে সেগুলো আর কোনো কাজেই লাগবে না। একই কথা বলছেন রেলওয়ে কর্মকর্তারাও।

ইআরপি সরঞ্জাম অব্যবহৃত রেখে নষ্ট করার বিষয়টি নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিও। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক সভায় কমিটির সভাপতি ও চট্টগ্রাম-৬ আসনের সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী বলেন, রেলওয়ের রিফর্ম (সংস্কার) প্রকল্পের ৯০ কোটি টাকার কোনো হদিস নেই। এ সময় তিনি বিষয়টি সম্পর্কে রেলওয়ের বক্তব্য জানতে চান।

এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক বলেন, রেলওয়ের সংস্কার প্রকল্পটি ২৫১ কোটি টাকার। এর মধ্যে ৯০ কোটি টাকার ইআরপি সরঞ্জাম বাদে অন্য কম্পোনেন্টগুলো সফলভাবে পরিচালিত হচ্ছে। ইআরপি সরঞ্জামের মধ্যে কিছু আইটি যন্ত্রপাতি আছে। তবে রেলওয়ের কোনো আইটি সেল না থাকায় এ অংশটুকু ব্যর্থ হয়েছে।

বৈঠকে কমিটির সদস্য কুমিল্লা-৮ আসনের সংসদ সদস্য নাছিমুল আলম চৌধুরী বলেন, ইআরপি চালু হলে রেলের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা-দুর্নীতি ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেত। এ ব্যবস্থায় কী পরিমাণ টিকিট বিক্রি হয়েছে, কত লাভ হলো, কী পরিমাণ জ্বালানি পুড়ল, কতগুলো ইঞ্জিন-কোচ চলল, কতজন কর্মকর্তা-কর্মচারী কী পরিমাণ কাজ করল—সবকিছু সহজেই পর্যবেক্ষণ করা যেত। বর্তমানে রেলওয়েতে যে দুর্নীতি চলছে, তা বন্ধে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারত ইআরপি ব্যবস্থা।

ইআরপি সরঞ্জামের বর্তমান পরিস্থিতি জানতে যোগাযোগ করা হয় রেলওয়ে সংস্কার প্রকল্পের সর্বশেষ প্রকল্প পরিচালক মিহির কান্তি গুহর সঙ্গে। বর্তমানে পশ্চিমাঞ্চল (রাজশাহী) রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, সিগন্যাল অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন বিভাগে সরঞ্জামগুলো হস্তান্তর করা হয়েছে। ইআরপির জন্য সাত ধরনের সরঞ্জাম কেনা হয়। এর মধ্যে চার ধরনের সরঞ্জাম আমরা সম্পূর্ণ চালু অবস্থায় তাদের কাছে বুঝিয়ে দিয়েছি। তবে এসব সরঞ্জাম চালাতে হলে দক্ষ জনবলের পাশাপাশি কিছু প্রযুক্তিগত উন্নয়নও আনতে হবে।

হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার বিষয়টিতে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, এ ধরনের সরঞ্জামের একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে। সাধারণত এ মেয়াদ পাঁচ বছরের বেশি থাকে না। মেয়াদ শেষ হলেও তেমন অসুবিধা নেই। প্রযুক্তি প্রতিনিয়ত এগিয়ে যাচ্ছে। যন্ত্রপাতির ধরনও দিন দিন বদলে যাচ্ছে। যেসব সরঞ্জামের মেয়াদ শেষ হয়েছে, সেগুলো কিছুটা আপগ্রেড করলেই ব্যবহার উপযোগী হয়ে উঠবে।

ইআরপির পেছনে ৯০ কোটি টাকা অপচয় হলো কিনা, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ইআরপি একটা ব্যবস্থা। এটা হঠাৎ করেই কিন্তু শতভাগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের টেলিকম খাতের একটি বড় কোম্পানি চেষ্টা করেও এখনো ইআরপি শতভাগ বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এ ব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে আমাদের দক্ষ জনবল দরকার। আমরা এ প্রকল্পের মাধ্যমে এক হাজার কর্মীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। আরো বিভিন্ন ধরনের কাজ হয়েছে। তাই আমার কাছে মনে হয়, শুধু হার্ডওয়্যার বা সফটওয়্যারের মেয়াদ বিবেচনায় নিয়ে লাভ-ক্ষতির হিসাব মেলানো ঠিক হবে না।

সেলফোনের মাধ্যমে এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিষয়টি নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. শামছুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি অনেক পুরনো। আমি খুব একটা জানি না।’ এটুকু বলেই ফোনের লাইন কেটে দেন তিনি।

সুত্র:বণিক বার্তা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৯


About the Author

RailNewsBD
রেল নিউজ বিডি (Rail News BD) বাংলাদেশের রেলের উপর একটি তথ্য ও সংবাদ ভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল।

Comments are closed.