শিরোনাম

‘সি’ ক্যাটেগরির প্রকল্পে কঠিন শর্তের ঋণ!

‘সি’ ক্যাটেগরির প্রকল্পে কঠিন শর্তের ঋণ

ইসমাইলআলী২০১১ সালে ৭০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন কেনার উদ্যোগ নেয় রেলওয়ে। তবে ১০ বছরেও তা কেনা হয়নি। যদিও গত এক দশকে রেলের বহরে যুক্ত হয়েছে ৪০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন। আরও ১০টি ইঞ্জিন শিগগিরই দেশে এসে পৌঁছাবে। তাই ৭০ ইঞ্জিন প্রকল্পটি অগুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ও রেলের এ প্রকল্পটি ‘সি’ ক্যাটেগরি তথা সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর পরও ইঞ্জিনগুলো কেনায় নেয়া হচ্ছে কঠিন শর্তের ঋণ।

ইঞ্জিনগুলো সরবরাহ করবে দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম। যদিও গত বছর রেলওয়েকে নিম্নমানের ১০টি ইঞ্জিন সরবরাহ করে বিতর্কের জš§ দিয়েছে এ কোম্পানিটি। আর বর্তমানে রেলের মিটারগেজ ইঞ্জিনের সংকট নেই। তাই ৭০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন প্রকল্পটি বাতিল করা উচিত বলে মনে করছেন রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা। অথবা ৭০টির পরিবর্তে সর্বোচ্চ ৩০টি ইঞ্জিন কেনা যেতে পারে বলে মত তাদের।

তথ্যমতে, ৭০টি ইঞ্জিন কেনায় ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর প্রায় ২৩ কোটি ৯৪ লাখ ৫৭ হাজার ডলার বা এক হাজার ৯৮৬ কোটি ৫৩ লাখ টাকার চুক্তি সই করে রেলওয়ে। চুক্তি অনুসারে ১৮ থেকে ৬০ মাসের মধ্যে ইঞ্জিনগুলো সরবরাহ করার কথা ছিল। তবে এরই মধ্যে ৩৩ মাস পেরিয়ে গেছে। কিন্তু ঋণ চুক্তি না হওয়ায় এ প্রক্রিয়া পিছিয়ে গেছে।

প্রকল্পটিতে স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংক (এসসিবি) ও জাপানের সুমিতোমো মিটসুই ব্যাংকিং করপোরেশন (এসএমবিসি) থেকে নেয়া হচ্ছে কঠিন শর্তের ঋণ। সম্প্রতি ঋণচুক্তির কপি রেলপথ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ রেলওয়ে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মতামতের পর ঋণদাতা কোম্পানির সঙ্গে ঋণচুক্তি সই করবে ইআরডি।

ইঞ্জিনগুলো কেনায় ঋণ নেয়া হবে প্রায় ২৮ কোটি দুই লাখ ৩২ হাজার ডলার। চারটি ভিন্ন ভিন্ন প্যাকেজের আওতায় ঋণ নেয়া হবে। এর মধ্যে কে-সিউরের আওতায় ঋণ দেয়া হবে প্রায় ১১ কোটি ৯৫ লাখ ৮৯ হাজার ডলার। কে-এক্সিম গ্যারান্টিড ফ্যাসিলিটির আওতায় দেয়া হবে প্রায় চার কোটি ২২ লাখ ২৫ হাজার ডলার এবং কে-এক্সিম সরাসরি ফ্যাসিলিটির আওতায় প্রায় সাত কোটি ৮৪ লাখ ১৮ হাজার ডলার।

চুক্তি সইয়ের ৬০ মাসের মধ্যে এ তিন ধরনের ঋণ ছাড় করতে হবে। এর মধ্যে কে-সিউর ঋণের সুদহার হবে ছয় মাস মেয়াদি লন্ডন আন্তঃব্যাংক অফার রেটের (লাইবর) সঙ্গে এক দশমিক ৫৫ শতাংশ যোগ করে নির্ধারিত হার। এর সঙ্গে ইসিএ প্রিমিয়াম যুক্ত হবে ১৪ দশমিক ১৫ শতাংশ। আর কে-এক্সিমের দুই প্যাকেজের সুদহার হবে ছয় মাস মেয়াদি লাইবরের সঙ্গে দেড় শতাংশ যোগ করে নির্ধারিত হার। এক্ষেত্রে ইসিএ প্রিমিয়াম ১৪ দশমিক ৯০ শতাংশ।

আর চতুর্থ প্যাকেজের আওতায় চার কোটি ডলার ঋণ দেয়া হবে। এক্ষেত্রে সুদহার হবে ছয় মাস মেয়াদি লাইবরের সঙ্গে এক দশমিক ৬০ শতাংশ যোগ করে নির্ধারিত হার। আর ইসিএ প্রিমিয়াম সাড়ে তিন শতাংশ। এ প্যাকেজের ঋণ চুক্তি সইয়ের ৩৬ মাসের মধ্যে ছাড় করতে হবে।

ঋণের এ চার প্যাকেজেই ম্যানেজমেন্ট ফি (ঋণের) দেড় শতাংশ হারে। এছাড়া কমিটমেন্ট ফি দিতে হবে বছরে দশমিক ৫০ শতাংশ হারে। এক্ষেত্রে যে পরিমাণ ঋণ প্রতি বছর ছাড় হবে বাকিটার ওপর কমিটমেন্ট ফি পরিশোধ করতে হবে। এছাড়া প্রতি প্যাকেজের ঋণের জন্য আলাদাভাবে এজেন্ট ফি দিতে ১০ হাজার ডলার। আর চতুর্থ প্যাকেজের জন্য পৃথক ৪০ হাজার ডলার লিগ্যাল ফি দিতে হবে।

এদিকে করোনার সংক্রমণ শুরুর পর ২০২০-২১ অর্থবছরে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পকে তিনটি ক্যাটেগরিতে ভাগ করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে ‘এ’ ক্যাটেগরিতে রাখা হয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। ‘বি’ ক্যাটেগরিতে অন্তর্ভুক্ত হয় মাঝারি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। আর ‘সি’ ক্যাটেগরিতে সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত হয়। রেলের ৭০ ইঞ্জিন কেনা প্রকল্পটি ‘সি’ ক্যাটেগরিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

সম্প্রতি এ বিষয়ে জানতে চাইলে ৭০ ইঞ্জিন কেনা প্রকল্পের পরিচালক আহমেদ মাহবুব চৌধুরী শেয়ার বিজকে বলেন, ইঞ্জিনগুলো কেনায় ঋণ প্রস্তাব যাচাই-বাছাইয়ের আগে ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি গ্রহণ করে ইআরডি। তবে গত বছর ৭০ ইঞ্জিন কেনা প্রকল্পটি ‘সি’ ক্যাটেগরিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এখন সরকার চাইলে কম গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পের জন্য কঠিন শর্তের ঋণ নাও নিতে পারে। এক্ষেত্রে রেলওয়ের কিছু বলার নেই।

যদিও বর্তমানে ৭০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন কেনার প্রয়োজনীয়তা নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এক দশকে রেলের রোলিং স্টকের (ইঞ্জিন, কোচ) চিত্র বেশ পরিবর্তন হয়েছে। বেশকিছু মিটারগেজ ইঞ্জিন কেনার ফলে বর্তমানে এ খাতে আর সংকট নেই। এছাড়া দেশে নতুন করে আর মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে না। বরং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসারে নতুন করে নির্মিত সব রেলপথই হচ্ছে ডুয়েলগেজ বা ব্রডগেজ। বিদ্যমান মিটারগেজ রেলপথগুলোও ক্রমেই ব্রডগেজ বা ডুয়েলগেজে রূপান্তর করা হবে। এতে মিটারগেজ ইঞ্জিনের চাহিদা ২০-২৫ বছর পর আর থাকবে না। তাই এখন ৭০টি ইঞ্জিন না কিনলেও চলবে। অথবা ৭০টির পরিবর্তে সর্বোচ্চ ৩০টি ইঞ্জিন কেনা যেতে পারে।

এ বিষয়ে জানতে রেলওয়ের মহাপরিচালক ডিএন মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

প্রসঙ্গত, ২০১১ সালের ২৩ আগস্ট ৭০টি ইঞ্জিন কেনার প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। সে সময় প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল এক হাজার ৯৪৫ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ইঞ্জিনগুলো কেনার কথা ছিল। পরবর্তীকালে সহজ শর্তের ঋণ বা সরবরাহকারীর ঋণে ইঞ্জিনগুলো কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে কঠিন শর্তের ঋণে ইঞ্জিনগুলো কেনা হচ্ছে।

৭০টি ইঞ্জিনের মধ্যে ৩০টি সম্পূর্ণ অবস্থায় কেনা হচ্ছে। বাকি ইঞ্জিনগুলোর মধ্যে ২৫টি অর্ধ উš§ুক্ত অবস্থায় (হাফ নকডাউন) এবং বাকি ১৫টি পুরোপুরি উš§ুক্ত অবস্থায় (ফুল নকডাউন) সরবরাহ করা হবে। এ ইঞ্জিনগুলো দেশে এনে রেলের নিজস্ব ওয়ার্কশপে সংযোজন করা হবে। যদিও অর্ধ উš§ুক্ত ও পুরো উš§ুক্ত ইঞ্জিনের দাম কম পড়বে বলে ধারণা করেছিল রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা, তবে বাস্তব পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে ভিন্ন। ৭০টি ইঞ্জিনের সবগুলো একই দামে কিনতে হচ্ছে।

এদিকে এক দশক ঝুলে থাকায় প্রকল্পটির ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৬৫৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ এরই মধ্যে ইঞ্জিনগুলো কেনায় ব্যয় বেড়ে গেছে ৭১৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা বা ৩৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ। তবে ঋণ চুক্তি না হওয়ায় প্রকল্পটি আরও বিলম্বিত হচ্ছে। এতে প্রকল্প ব্যয় আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সূত্র:শেয়ার বিজ, জুলাই ৮, ২০২১


About the Author

RailNewsBD
রেল নিউজ বিডি (Rail News BD) বাংলাদেশের রেলের উপর একটি তথ্য ও সংবাদ ভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল।

Comments are closed.