শিরোনাম

উত্তরের রেলপথ: নতুন মোড়কে পুরোনো সেবা

উত্তরের রেলপথ: নতুন মোড়কে পুরোনো সেবা

তুহিন ওয়াদুদ :

শুধু নতুন ইঞ্জিন আর নতুন কোচ হলেই রেলের সেবার মান বাড়ে না। রেলের সেবার মান বাড়ানোর জন্য ন্যূনতম যে প্রচেষ্টা থাকা জরুরি, তা রংপুর-কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাট থেকে ছেড়ে যাওয়া ঢাকাগামী তিনটি ট্রেনের একটিতেও দৃশ্যমান নয়। বরং সম্ভাবনাময় রেল খাতকে যাত্রীবিমুখ করার চেষ্টাই পরিলক্ষিত হচ্ছে। নতুন মোড়কে চলছে পুরোনো সেবা।

কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস নামের একটি নতুন ট্রেন কুড়িগ্রাম-ঢাকা রুটে গত ১৬ অক্টোবর থেকে চালু করা হয়েছে। একই দিনে রংপুর এক্সপ্রেস, লালমনি এক্সপ্রেসের জীর্ণশীর্ণ ইঞ্জিন-কোচ পরিবর্তন করে নতুন ইঞ্জিন এবং কোচ যুক্ত করা হয়েছে। দীর্ঘকাল পর এই পথে নতুন ট্রেন চালু হলো। রংপুর-কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাটে কোনো দিন নতুন ট্রেন না দেওয়ার সরকারি অপবাদ ঘুচল। কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস চিলমারী থেকে এবং লালমনি এক্সপ্রেস বুড়িমারী থেকে ছাড়ার ব্যবস্থা করলে ওই দুই জেলার অনেক মানুষ রেলসেবা সহজে পেত।

রেল কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা আর উদাসীনতার কারণে এ তিন ট্রেনের কোনোটি যথাসময়ে চলছে না। গত অক্টোবর মাসে ঢাকা যাওয়ার জন্য আমি কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসের টিকিট করেছিলাম। কিন্তু রংপুরেই সেই ট্রেন দুই ঘণ্টা বিলম্বে আসে। বোঝাই যাচ্ছিল আরও অনেক বিলম্বে ঢাকায় পৌঁছাবে। ফলে স্টেশনে গিয়ে টিকিট ফেরত দিতে হলো। গত নভেম্বর মাসে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে রংপুর এক্সপ্রেসে। সেদিন প্রায় পাঁচ ঘণ্টা বিলম্ব ছিল।

অব্যবস্থাপনাই ট্রেন বিলম্বের প্রধান কারণ। সকাল ৭টা ২০ মিনিটে কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস কুড়িগ্রাম থেকে ছাড়ে। পার্বতীপুরে চালক এবং সহকারী চালক পরিবর্তন হওয়ার কারণে এবং পাওয়ার কারে তেল নেওয়ার কারণে সেখানে ট্রেনটি ২০ মিনিট বিরতি দেয়। যদি কুড়িগ্রামে চালক, সহকারী চালক পরিবর্তনের সুযোগ থাকত এবং পাওয়ার কারে তেল নেওয়ার ব্যবস্থা থাকত, তাহলে এই ২০ মিনিট অপচয় হতো না। ট্রেনটি পার্বতীপুর ছেড়ে যাওয়ার আগেই পঞ্চগড় থেকে দ্রুতযান এক্সপ্রেস পার্বতীপুরে চলে আসে। ফলে অন্তত ২০ মিনিট দেরি করে কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস ছাড়তে হয়। দ্রুতযান এক্সপ্রেস চলে যাওয়ার ২০ মিনিটের মধ্যে একই লাইনে আর কোনো ট্রেন ছাড়ার উপায় নেই। দেখা যায়, প্রতিদিন প্রায় ১ ঘণ্টা অপচয় হয় পার্বতীপুর ছেড়ে যাওয়ার আগেই।

রংপুর ও কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস দুটি কমলাপুর স্টেশনে ডকইয়ার্ডে নিতে হয়। ডকইয়ার্ডে প্রায় এক ঘণ্টার প্রয়োজন হয়। যান্ত্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে লাগে আরও এক ঘণ্টা। কুড়িগ্রাম ও রংপুরে ডকইয়ার্ডের ব্যবস্থা এবং পরিচ্ছন্নতাকর্মী থাকলেই ওই এক ঘণ্টার কাজ আর ঢাকায় করতে হতো না। ঢাকায় তখন শুধু যান্ত্রিক পরীক্ষার জন্য এক ঘণ্টা প্রয়োজন হতো।

উল্লিখিত তিনটি ট্রেনেরই বড় সীমাবদ্ধতা হলো এর আসন ব্যবস্থাপনা। এ তিন ট্রেনের একটিতেও সাধারণ শোভন আসন নেই। বর্তমানে একটি টিকিটের মূল্য ন্যূনতম ৫০৫ টাকা। শোভন আসন থাকলে ৩০০, ৩৫০ টাকার মধ্যে এর মূল্য রাখা সম্ভব হতো। এ তিন জেলার হাজার হাজার যাত্রী প্রতিদিন সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে ঢাকাগামী বাসে ৩০০ টাকায় ঢাকা যাওয়ার জন্য। আসনে বসে হোক, ইঞ্জিন কভারে হোক, প্রয়োজনে দাঁড়িয়ে হোক—মাত্র ৩০০ টাকায় তারা ঢাকা যায়। এসব যাত্রীর জন্য ট্রেন বেশি জরুরি ছিল।

 বাংলাদেশের সবচেয়ে গরিব ১০টি জেলার মধ্যে রংপুর, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট জেলা আছে। ফলে এ তিন ট্রেনে বিলাসবহুল আসনের চেয়ে সাধারণ আসন থাকা অত্যন্ত জরুরি। দীর্ঘদিন ধরে উত্তরাঞ্চলের মানুষ দাবি করে আসছে, রংপুর থেকে সোজা বগুড়া হয়ে সিরাজগঞ্জ দিয়ে ঢাকা রেলপথ স্থাপনের। এ কাজ করা সম্ভব হলে ট্রেনের ভাড়া অর্ধেকে নেমে আসত, সময়ও লাগত অর্ধেক। বাসের চেয়ে কম ভাড়া, কম সময়ে নিরাপদ যাত্রা মানুষ চায়। তাদের এই চাওয়ার প্রতি সরকারের অগ্রাধিকার জরুরি। এটা করা সম্ভব হলে সড়কের ওপর চাপ কমত। অনেক দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। রেলপথে সরকারের ব্যয় কম। অর্থ মূল্যেও সরকার বিশাল লাভবান হতো। যত দিন এ কাজ করা সম্ভব না হয়, তত দিন অবশ্যই বিশেষ প্রণোদনা এবং বিশেষ পরিচর্যায় এই পথে যাত্রীদের আকৃষ্ট করতে হবে।

পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন কারখানায় যাওয়া রংপুর অঞ্চলের লাখ লাখ শ্রমিকের যাত্রা উপযোগী ট্রেন আমরা দেখতে চেয়েছিলাম। এ জেলাগুলোর অধিকাংশ যাত্রীই শ্রমিক। তাঁরা তো সরকারি চাকরি করেন না। ছুটিতে থাকলে তাঁরা অনেকেই ওই দিনের মজুরি পান না। ফলে ট্রেনে যেতে একদিন নষ্ট হলে তাদের এক দিনের মজুরির কথাও চিন্তা করতে হয়। দিনমজুরের জন্য হয় কম সময়ে ঢাকায় পৌঁছাতে হবে, নয়তো কম টাকায়। সে জন্য ট্রেনযাত্রী করার জন্য তাঁদের সুবিধার কথাটি রেল কর্তৃপক্ষকে ভাবতে হবে।

তুহিন ওয়াদুদ: বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ও নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক
[email protected]

সুত্র:প্রথম আলো, ১২ জানুয়ারি ২০২০


About the Author

RailNewsBD
রেল নিউজ বিডি (Rail News BD) বাংলাদেশের রেলের উপর একটি তথ্য ও সংবাদ ভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল।

Comments are closed.