আনু মোস্তফা : পশ্চিমাঞ্চল রেলে ট্রেনের ইঞ্জিন থেকে তেল চুরির ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। এ অঞ্চলে তেল চোরদের একটি সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয়। কতিপয় ট্রেন চালক ও গার্ডসহ ডিপোতে কর্মরতরা এ চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে প্রতি মাসে বিপুল পরিমাণ তেল লোপাট করছে। র্যাবের অভিযানে চক্রের কেউ কেউ হাতেনাতে ধরা পড়লেও থামছে না চুরি। অভিযোগ উঠেছে, জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেয়ায় চুরি বন্ধ হচ্ছে না। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা সম্প্রতি পশ্চিমাঞ্চলে রেলের বিপুল তেল চুরির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একাধিক প্রতিবেদন দিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) মিহির কান্তি গুহ যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। গত সপ্তাহে মন্ত্রণালয়ের একটি সভায় রেলমন্ত্রী মহোদয় পশ্চিমাঞ্চলে ডিপো ও ইঞ্জিন থেকে তেল চুরির বিভিন্ন ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে সচিবসহ উপস্থিত রেল কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। রেলের তেল চুরি ঠেকাতে মন্ত্রী দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণে কঠোর নির্দেশ দেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমাঞ্চল জিএমের নির্দেশে ১০ মার্চ লালমনিরহাট ডিভিশনের ম্যানেজার (ডিআরএম) তাপস কুমার দাস তেল চোর সিন্ডিকেট ও জড়িত রেল কর্মকর্ত-কর্মচারীদের চিহ্নিত করতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। লালমনিরহাট ডিভিশনের বিভাগীয় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারকে (ডিএমই) প্রধান করে গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। লালমনিরহাটের ডিআরএম তাপস কুমার দাস যুগান্তরকে আরও বলেন, কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু দেশে করোনা পরিস্থিতির কারণে প্রতিবেদন পেতে আরও কয়েকদিন সময় লেগে যেতে পারে। এই প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
এদিকে র্যাবের সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, ১৭ মার্চ সকালে র্যাব পাবনা ক্যাম্পের কমান্ডার আমিনুল কবীরের নেতৃত্বে একটি দল ঈশ্বরদী জংশন এলাকার ফতেমোহাম্মদপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে রেলের ইঞ্জিন থেকে চুরি করা সাড়ে চার হাজার লিটার তেলসহ পিন্টু সেখকে গ্রেফতার করে। এ সময় আরও তিন চোর পালিয়ে যায়। আমিনুল কবীর যুগান্তরকে বলেন, গত এক মাসে র্যাব একই এলাকায় অভিযান চালিয়ে রেল ডিপো ও ইঞ্জিন থেকে চুরি হওয়া প্রায় ৪০ হাজার লিটার জ্বালানি তেল উদ্ধার করেছে। গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিরা র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, ডিপো কর্মচারী, ট্রেনের চালক ও গার্ডদের সহায়তায় তারা তেল চুরি করে বাজারে বিক্রি করে।
র্যাব সূত্র জানায়, ৬ মাসে পশ্চিমাঞ্চল রেলের বিভিন্ন স্টেশন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তারা লক্ষাধিক লিটার তেল উদ্ধার করেছে। চলতি বছরে রাজশাহীর কাঁকনহাট, নাটোরের আবদুলপুর, পাবনার ঈশ্বরদী জংশন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমনুরা, গাইবান্ধার বোনারপাড়া, দিনাজপুরের পার্বতীপুর, খুলনা, যশোরের নওয়াপাড়া, কুষ্টিয়ার পোড়াদহ স্টেশন থেকে ট্রেনের তেল চুরির ঘটনা ঘটে। ট্রেনগুলো এসব স্টেশনে বিরতি দিলে ট্রেনের গার্ড ও চালকরাই তেল চোর চক্রকে ইঞ্জিন থেকে তেল বের করে দেন। পাশাপাশি পশ্চিমাঞ্চলের ঈশ্বরদী, খুলনা, পার্বতীপুর, নাটোর ও লালমনিরহাটে রয়েছে রেলের জ্বালানি তেলের ডিপো। এসব ডিপোর কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীও প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল তাদের পরিচিত চোর সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাইরে পাচার করে দেন।
গোয়েন্দা সংস্থা পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে তেল চোর সিন্ডিকেটের হোতা ও জড়িত গার্ড, চালক, ডিপো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নাম-পদবিসহ একাধিক প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠালেও এতদিন রেল মন্ত্রণালয় অনেকটাই নীরব থেকেছে। তবে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় রেলের তেল চুরি ঠেকাতে ব্যবস্থা নিতে কঠোর নির্দেশ দিলে মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে তৎপর হয়।
এ ব্যাপারে পশ্চিমাঞ্চল রেলের জিএম মিহির কান্তি গুহ যুগান্তরকে আরও বলেন, বিভিন্ন গোয়েন্দা প্রতিবেদন ও র্যাবের অভিযানগুলোর প্রতিবেদনে স্পষ্ট নয়, রেলের কারা কোন পর্যায়ের লোকজন এই তেল চুরির সঙ্গে জড়িত। নির্দিষ্টভাবে তাদের নাম-পদবি থাকলে তাদের পক্ষে বিভাগীয় ও যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া সহজ হতো। তারপরও তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পেলে জড়িতদের কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না বলে জানান তিনি।
সুত্র:যুগান্তর, ২১ মার্চ ২০২০