শিরোনাম

মাঠের কর্মকর্তারা প্রকল্পে, উপেক্ষিত রেলপথ

মাঠের কর্মকর্তারা প্রকল্পে, উপেক্ষিত রেলপথ

শিপন হাবীব :

রেলে দুর্ঘটনা, বগি লাইনচ্যুতি, সিডিউল বিপর্যয় ইত্যাদি যেন পিছু ছাড়ছে না। উনিশ থেকে বিশ হলেই ঘটছে বিপদ। প্রাণহানির মতো ঘটনাও ঘটছে। অথচ অ্যানালগ থেকে সম্পূর্ণ ডিজিটাল (কম্পিউটারাইজড ও প্যানেল বোর্ড নিয়ন্ত্রিত) হয়েছে রেল। কিন্তু যত আধুনিক প্রযুক্তি আসছে, যুক্ত ব্যক্তিদের ঢিলেমি ও গাফিলতি ততই বাড়ছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা চলমান বিভিন্ন প্রকল্পের পরিচালক এবং প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতেই উঠেপড়ে লেগেছেন। বর্তমানে ৩৬টি উন্নয়ন প্রকল্পে ৩৫ জন প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে আরও প্রায় ৩৯৭ জন রেল কর্মকর্তা কাজ করছেন। যাদের শতভাগ সময়-শ্রম দেয়ার কথা রেলপথে।

রেলওয়ে বিশেষজ্ঞ এবং খোদ রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, বিভিন্ন প্রকল্পে অনৈতিকভাবে আর্থিক লাভবান হওয়ার অনেক সুযোগ থাকে। সেই ‘মধু’র খোঁজেই কর্মকর্তারা এসব প্রকল্পে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। রেলপথ-ইঞ্জিন-কোচ যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ায় শত উন্নয়নের মধ্যেও রেলপথ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে, দুর্ঘটনা বাড়ছে।

রেলওয়ে পরিকল্পনা ও অবকাঠামো বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে (২০১৯-২০২০ অর্থবছর) ৩৬টি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান। এসব প্রকল্পের (জুলাই-নভেম্বর) বাস্তবায়নের জাতীয় গড় অগ্রগতি (আর্থিক) ১৯.২৪ শতাংশ।

৩৫টি প্রকল্পে রেলওয়ের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) রয়েছে ৩৫ জন। পাশাপাশি প্রতিটিতে রেলের প্রায় ১২ থেকে ১৫ জন কর্মকর্তা কাজ করছেন। রেলপথ যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রেলের দু-অঞ্চলের (পূর্ব ও পশ্চিম) প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

অথচ পূর্বাঞ্চল রেলের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ সুবক্তাহীন এবং পশ্চিমাঞ্চল রেলের প্রধান প্রকৌশলী আল ফাত্তাহ মো. মাসউদুর রহমান একাধিক প্রকল্পের পরিচালক (পিডি)। অভিযোগ রয়েছে, তারা রেলপথে নয়, সর্বোচ্চ নজরদারি করছেন প্রকল্পে।

এ বিষয়ে রেলপথ সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন রোববার সন্ধ্যায় যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান সরকার রেলে ব্যাপক উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। প্রায় ৯৯ শতাংশ প্রকল্পেই প্রকল্প পরিচালক এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা হলেন রেলের। প্রকল্পের পরিচালক এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা রেলপথ এবং ট্রেন পরিচালনার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃত্ত।

এমন অবস্থায় এসব কর্মকর্তা না পারছেন প্রকল্পে ১০০ ভাগ সময় দিতে, না পারছেন রেললাইন এবং ট্রেন পরিচালনায় সময় দিতে। আমরা বিষয়টি নিয়ে ভাবছি। পদ্মা সেতুর রেললিংক প্রকল্পের পরিচালক রেলের নয়, বাহির থেকে দেয়া হয়েছে। নতুন প্রকল্পগুলোতেও বাহির থেকে পিডি দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। আমাদের কাছে রেলপথ, ট্রেন পরিচালনার সঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়নও খুবই জরুরি। তবে চলমান রেলপথকে নিরাপদ করা সবচেয়ে জরুরি।

শনিবার মধ্যরাতে কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার শশিদল রেলওয়ে স্টেশনে যাত্রীবাহী নোয়াখালী এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিনসহ ২টি বগি লাইনচ্যুত হয়। এ সময় প্রাণভয়ে যাত্রীরা চিৎকার শুরু করেন। তবে এতে কেউ হতাহত হননি।

রোববার সকালে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় মালবাহী ট্রেনের একটি বগি লাইনচ্যুত হয়েছে। একই দিন গাইবান্ধায় ইঞ্জিন থেকে বগি বিচ্ছিন্ন হয়ে পৌনে দুই ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে।

১২ নভেম্বর কসবায় দুই ট্রেনের সংঘর্ষে ১৮ যাত্রীর প্রাণহানি হয়েছে। আহত হয়েছেন প্রায় অর্ধশত। এর কয়েক মাস আগে সিলেট কুলাউড়ায় ট্রেন দুর্ঘটনায় ৬ যাত্রী মারা যান। ১৫ নভেম্বর সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় রংপুর এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনসহ ৩টি বগি পুড়ে যায়। ওই সময় যাত্রীরা প্রাণ বাঁচাতে ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ে অনেকে আহত হন।

রেলপথ পরিকল্পনা বিভাগ সূত্রে জানা যায়, রেলওয়ের মাঠ পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা কর্মকর্তাদের প্রায় ৮০ শতাংশই বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করছেন। বিশেষ করে ২০০৯ সালের পর থেকে রেলে ব্যাপক উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ইতিমধ্যে ১৩টি বড় প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত হয়েছে।

কিন্তু এসব প্রকল্পের সুফল মিলছে না- শুধু রেলপথে ঘন ঘন দুর্ঘটনার কারণে। রেলপথে পাথরস্বল্পতা চরমে উঠেছে। নিয়মানুযায়ী স্লিপারের অর্থাৎ রেললাইন ছুঁই ছুঁই পর্যায়ে পাথর থাকবে। অথচ, মাইলের পর মাইল রেলপথে যথাযথ পাথর নেই। অন্যদিকে লাইনের অনেক জায়গায় নাটবোল্টু-ক্লিপ-ফিশপ্লেট, হুক খোলা রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের এক কর্মকর্তা জানান, এ অঞ্চলের প্রায় ৯০ শতাংশ কর্মকর্তাই রেলের বিভিন্ন প্রকল্পে জড়িত। অন্যদিকে বহু কর্মকর্তা রয়েছেন যারা বিভিন্ন নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রকল্প কিংবা নিয়োগ- এ দুটিতেই দুর্নীতি রয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্প ও নিয়োগের সঙ্গে সম্পৃত্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। দুদকের অনুসন্ধানে দুর্নীতির প্রমাণও মিলেছে।

প্রকল্পে সম্পৃত্ত কর্মকর্তাদের মাঠ পর্যায়ে একেবারেই পাওয়া যায় না। ট্রেন পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ফাইলে স্বাক্ষর করার সময়টুকুও পান না তারা। এতে করে ট্রেন পরিচালনা তথা, রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণে বিঘ্ন ঘটছে। কর্মকর্তারা ভাবছেন, প্রকল্পে যুক্ত থাকলেই তারা অনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারবেন। তাই রেলপথে দুর্ঘটনা তাদের তেমন ভাবিয়ে তুলছে না।

রেলওয়ে রোলিংস্টক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বর্তমান সরকারের আমলে (২০০৯-২০১৯) ১৩৮টি নতুন ট্রেন চালু হয়েছে। এসব ট্রেন পুরাতন, আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়া ইঞ্জিন দিয়েই উদ্বোধন করা হয়। এ সময়ের মধ্যে যে পরিমাণ ইঞ্জিন ও যাত্রীবাহী কোচ আনা দরকার ছিল তা আনা সম্ভব হয়নি।

আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়া ৮১ শতাংশ ইঞ্জিন ও ৪৫ শতাংশ কোচ এখন রেলের শেষ ভরসা। মেয়াদোত্তীর্ণ যাত্রীবাহী কোচগুলো চলন্ত অবস্থায় প্রায়ই দুর্ঘটনায় পড়ছে। এছাড়া জরাজীর্ণ রেলপথ-রেলসেতু রেলের আরেকটি আতঙ্কের নাম। সংশ্লিষ্টরা প্রকল্পে বেশি সময় দেয়ায় রেলপথ-রেলসেতু, ইঞ্জিন রক্ষণাবেক্ষণে যথাযথ সময় দিতে পারছেন না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগ-পিছ না ভেবেও অনেক প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। আর এসব প্রকল্পে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন মাঠ পর্যায়ে থাকা রেলওয়ের কর্মকর্তারা। প্রকল্প গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্প পরিচালক এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বাহির থেকে আনার বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।

এতে করে চলমান রেলপথ এবং ট্রেন পরিচালনার ক্ষেত্রে-নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, রেলের প্রকল্পে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) বাহির থেকে আনতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে লিখিতভাবে জানানো হয়েছিল। সেই অনুযায়ী জনপ্রশাসনের পিডি সেলে তা আলোর মুখ দেখেনি। অথচ, পদ্মা রেলসেতু লিংক প্রকল্পে বাহির থেকে পিডি নেয়া হয়েছে।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক জানান, প্রকল্প বাস্তবায়ন নিশ্চয় জরুরি। কিন্তু সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে রেলপথ এবং ট্রেন পরিচালনার ক্ষেত্রে অবহেলা-দায়িত্বহীনতা খুবই ভয়ানক। এতে রেলপথ আরও ভয়ানক হয়ে উঠবে।

রেলের উন্নয়নের যে পরিকল্পনা সেখানেই ঘাটতি আছে। রেলে নতুন বগি, ইঞ্জিন দরকার। নতুন বিনিয়োগ, অবকাঠামোও দরকার। কিন্তু সবার আগে নিরাপদ রেলপথ। সেই পথে দরকার দক্ষ জনবল। দায়িত্বশীল কর্মকর্তা। রেলে যেসব দুর্ঘটনা ঘটছে, সেগুলো কিন্তু পরিচালনা কিংবা রক্ষণাবেক্ষণ ঘাটতির কারণে হচ্ছে।

রেলওয়ের সাবেক কর্মকর্তারা বলছেন, রেলে দুর্ঘটনা রোধ করতে হলে রেলপথ ও ট্রেনের রক্ষণাবেক্ষণে যত্নবান হতে হবে। অর্থাৎ এ বিষয়টিকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। এজন্য লোকবল প্রশিক্ষণ দেয়াসহ শূন্য পদ পূরণ করা জরুরি। মাঠ পর্যায়ে থাকা কর্মকর্তাদের প্রকল্পে সম্পৃত্ত করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

রেলওয়ের সাবেক মহাপরিচালক মো. আবু তাহের বলেন, রেলে যেসব অবৈধ লেভেল ক্রসিং আছে তা উচ্ছেদ কিংবা যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করে পুনঃনির্মাণ করতে হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সর্বোচ্চ শক্তি-নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে হবে।

রেলের আরেক সাবেক মহাপরিচালক মুক্তিযোদ্ধা মো. তোফাজ্জল হোসেন বলেন, রেলপথ নিরাপদ, রক্ষণাবেক্ষণ না করা হলে উন্নয়নের সুফল মিলবে না। সাধারণ মানুষের মধ্যে এ পথ নিয়ে যে আশা-ভরসা রয়েছে তা ধরে রাখতে মাঠ পর্যায়ে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শতভাগ দায়িত্ব পালন নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি সেকশনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে দুর্ঘটনা একেবারেই কমে আসবে।

রেলের সাবেক মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. আবদুল হাই বলেন, রেলপথ ও রেল সেতুগুলো সর্বদা রক্ষণাবেক্ষণ করার কোনো বিকল্প নেই। রেলপথ-ইঞ্জিন ও কোচগুলো নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত করলে দুর্ঘটনা ঘটার কথা নয়।

সুত্র:যুগান্তর, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৯


About the Author

RailNewsBD
রেল নিউজ বিডি (Rail News BD) বাংলাদেশের রেলের উপর একটি তথ্য ও সংবাদ ভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল।

Comments are closed.