শিরোনাম

প্যারিসের রেলওয়ে স্টেশনে

প্যারিসের রেলওয়ে স্টেশনে

মঈনুস সুলতান:
ট্রেনের গতি শ্নথ হয়ে আসে। বুঝতে পারি প্যারিসের গারে ডু নর্ড স্টেশনটি কাছেই। তাই পিনেলোপের সঙ্গে কথাবার্তা আর বিশেষ আগায় না। ব্রাসেলস থেকে ট্রেনে প্যারিস আসার পথে পরিচয় হয়েছে তার সঙ্গে। অত্যন্ত ফ্রেন্ডলিভাবে সে আমার কবজি মুঠো করে চেপে দিয়ে বলেছে, ‘ইউ ক্যান কল মি লোপা।’ আমি ডাইনিং-কারে তাকে পানীয়ের ইনভাইট করেছিলাম। ওখানেই লাঞ্চ সেরেছি আমরা। খানিক অন্তরঙ্গও হয়েছি, আলোচনা করেছি ফরাসি দেশের আবহাওয়া থেকে হরস্কোপের সাথে মিলিয়ে পাথর ধারণ করা প্রভৃতি প্রসঙ্গে। এখন নামার প্রস্তুতি নিতে ফিরে যেতে হয় সিটে। ব্যাকপ্যাক কাঁধে উঠে পড়ে বিদায়ের জন্য তার দিকে ঝুঁকে তাকাতেই- সে সামাজিক চুমোর জন্য গণ্ডদেশ বাড়িয়ে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘ইজ দ্যাট অল মঁশিয়ো?’ ‘আই থিংক, ইয়েস মাদমোয়াজেল’ বলে নিরাসক্তভাবে তার কবজি চেপে দিয়ে সিটের দিকে পা বাড়াই। ওখানে গিয়ে দেখি, ইন্দোনেশিয়ার নির্জন দ্বীপাণুতে বাস করা মি. স্টিভ ম্যানিনজার খুব হন্তদন্ত হয়ে মালমাত্তা গোছাচ্ছেন। তার সঙ্গেও ট্রেনে আলাপ হয়েছে। দীর্ঘ এক যুগ পর ফরাসি দেশে ফিরেছেন তিনি, বিরল প্রজাতির কচ্ছপ সংরক্ষণের জন্য অ্যাডভোকেসি করতে। তার পুরনো কায়দার চামড়ার স্যুটকেসটি চাকাহীন, গ্লাডস্টোন ব্যাগ থেকে উপচে পড়ছে ফাইলপত্র ও বেশ কয়েকটি কচ্ছপের কাচ্চাবাচ্চার ছবিওয়ালা ফটোগ্রাফ। ব্যাগের হ্যান্ডেল মুচড়ে ধরে তিনি নার্ভাসভাবে তাকিয়ে আছেন প্যারিস রেলওয়ে স্টেশনের বিশাল প্ল্যাটফর্মের দিকে। তার গলা থেকে ল্যাতপেতে ফিতায় ঝুলছে ইয়া বড় একটি গেল শতকে ইয়াসিকা কোম্পানির তৈরি ফিল্ম ক্যামেরা।

গারে ডু নর্ড স্টেশনে নেমে আমি কিছুক্ষণ চকমিলান এ ইমারতের বেজায় উঁচু ছাদের তলায় হাঁটাচলা করি। স্বচ্ছ আয়নায় তৈরি কাঠামো গলে ভেতরে ঢুকে পড়ছে অফুরন্ত আলো। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে লাল রঙের ঝকঝকে দু’খানা শার্প চেহারার ট্রেন। ভিনটেজ হোস্টেল বলে একটি মাঝারি মাপের সরাইখানায় আমার বুকিং দেওয়া আছে। ঠিক জানি না হোস্টেলটি রেলওয়ে স্টেশন থেকে কত দূরে? ওদিকে যাওয়ার বন্দোবস্তই বা কী? একটি বইপত্রের দোকানে শেলফের সামনে দাঁড়িয়ে ফরাসি ভাষায় ছাপা পত্রিকাগুলোর দিকে তাকালাম। পড়তে না পারলেও ছবি দেখে বুঝতে পারি, হেডলাইনে গ্রিসের অর্থনৈতিক দুর্যোগের খবর ফলাও করে ছেপেছে। পাশেই ছবিসহ তিউনিসিয়ার এক সমুদ্রতীরবর্তী রিসোর্টে সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের সংবাদ। আটাশ বছর বয়সের এক তরুণ অতর্কিতে হামলা চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছে আটত্রিশজন পর্যটককে। মনে মনে প্রত্যাশা করেছিলাম- এ বছরের শেষ দিকে এক দফা তিউনিসে বেড়াতে যাব। জানাশোনা এক ডিপ্লোম্যাট আমাকে দাওয়াত দিয়ে রেখেছিলেন। ফ্লাই করে পৌঁছতে পারলে থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত থেকে ঘুরে বেড়ানোর সহায়তা দেওয়ার প্রমিজ করেছিলেন তিনি। বুঝতে পারি, এ সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের পর তিউনিসিয়ায় ট্র্যাভেল হয়ে পড়বে অনিরাপদ। মনের নিভৃতে সম্ভাবনার পারিজাত বৃক্ষ থেকে নীরবে ঝরে পড়ে স্বপ্নের একটি কুসুম।

খুঁজেপেতে একটি ইংরেজি পত্রিকা কিনি। প্রথম পৃষ্ঠায় রঙিন ছবিতে সৈকত-রিসোর্টের আঙিনায় ছড়ানো একাধিক লাশের ছবি। পথচারীরা বিমর্ষ মুখে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। আমার পাশে দাঁড়িয়ে শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন দশাসই এক কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ। মাথায় নানা রকমের নকশা আঁকা টুপি পরা এ মানুষটি উচ্চতায় সাড়ে ছয় ফুটের সামান্য বেশি। তার কুচকুচে কালো উলের গুটলির মতো দাড়ি খানিকটা ধূসর হতে শুরু করেছে। খানিক দূর থেকে তাকালে মনে হয়, এ ভদ্রসন্তানের গণ্ডদেশে লেগে আছে মাকড়সার জালের ছেঁড়া দুটি টুকরা। তিনিও একটি ইংরেজি পত্রিকা কিনেছেন। আমার সাথে চোখাচোখি হতেই ছবিতে ছড়ানো সন্ত্রাসবাদী হামলায় নিহত লাশের দিকে ইশারা করে সিনার ভেতর থেকে ‘ইয়াল্লা- ইয়া রব’ আওয়াজ ছেড়ে বলেন, ‘দিস ইজ হোয়াট হ্যাপেন্ড টু মি, এগারো বছর হতে চলল। মাই মেমোরি স্টিল ইজ সো ফ্রেশ, ইট উইল নেভার বি ফরগটেন।’ আমি ঘাড় বাঁকিয়ে মৃদুস্বরে সালাম উচ্চারণ করে জানতে চাই, ‘কোথাকার কথা বলছেন আপনি?’ তিনি ‘দারফুর’ শব্দটি উচ্চারণ করতেই আমার চোখে ভেসে আসে ব্রাসেলসের ক্যাথিড্রালের ফ্রেস্কোতে আঁকা নরকের বর্ণনাঋদ্ধ চিত্র। থিয়েটারের স্টেজে দাঁড়িয়ে কোনো মহাকাব্যের নায়ক চরিত্রের স্বগতোক্তির মতো তিনি বলেন, ‘সুদানের ডিংকা গোত্রের লোক আমি। জাবেল মাররা পাহাড়ের পাদদেশে ছিল আমার গ্রাম। ভরদুপুরে ঘোড়া ছুটিয়ে আসে সুদানের সামরিক বাহিনীর সমর্থনপুষ্ট জানজায়িদ মিলিশিয়ারা। ডিংকাদের অপরাধ, তাদের দেহে আরব রক্তের অনুপস্থিতি। প্রথমে তারা গ্রামের তাবৎ ঘরদুয়ারে পেট্রোল ছিটিয়ে আগুন দেয়। তারপর সাবমেশিনগানের গুলি চালিয়ে হত্যা করে চুয়াল্লিশজন মানুষকে। আমি পালিয়ে পোষা গাধায় চড়ে উঠে যাই পাহাড়ের দিকে। যেতে যেতে দেখি, আমার আত্মীয়-স্বজনদের ঘরবাড়ি থেকে ছড়াচ্ছে আগুনের লকলকে শিখা। পরে শুনেছি, খুন করার আগে নাকি গ্রামের কিছু পুরুষ মানুষকে মিলিশিয়ারা আঙিনায় কম্বল বিছিয়ে তার পাশে সারি দিয়ে দাঁড়াতে বলে। তারপর তাদের স্ত্রী ও কন্যাদের কম্বলের ওপর ফেলে গ্যাংরেপ করা হয়। জানজায়িদ মিলিশিয়াদের কেউ কেউ এ গণধর্ষণের ছবিও তুলে রাখে। ভদ্রলোক খুব আবেগ নিয়ে বেশ জোরে জোরে ইংরেজিতে কথা বলছেন। বইয়ের দোকানে নিউজস্ট্যান্ডের সামনে দাঁড়ানো অন্য খরিদ্দাররা তার দিকে তাজ্জব হয়ে তাকাচ্ছে! স্পষ্টত তার ইংরেজি বচন বুঝতে তাদের অসুবিধা হচ্ছে। কী ভেবে আমি তাকে বলি, ‘হাউ অ্যাবাউট আ কাপ অব কফি উইথ মি? পিপুল ফ্রম দারফুর লাইক কফি?’ ‘অফকোর্স আই উড নট মাইন্ড টেকিং আ কাপ অব ব্ল্যাক কফি উইথ ইউ,’ বলে তিনি পত্রিকাটি খুব আউলামাড়া করে বগলে পুরে প্যান্টের দু-পকেটে হাত ঢুকিয়ে হাঁটেন। কফিশপের দিকে যেতে যেতে আমরা পরস্পরের সাথে পরিচিত হই। সুদানের ডিংকা গোত্রের বেজায় দীর্ঘদেহী এ মানুষটির নাম নানোমি আলগালি। কফিশপে ঢুকে কী যেন ভেবে কপাল কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলেন, ‘বিকেলবেলা কালো কফি খাওয়াটা ঠিক না। রাতে আবার না ঘুমের ট্রাবল হয়।’ ঠিক তখনই আমি খেয়াল করি, নানোমি আলগালির কপালে ডিংকা গোত্রের নৃতাত্ত্বিক চিহ্ন হিসেবে ধারালো চাকু দিয়ে কাটাকুটির ছাপ। আমি কফি নিতে গিয়ে বলি, ‘কফি না চললে অন্য কিছু নেন।’ তিনি চকোলেট আইসক্রিমের একটি বার নিয়ে চুষতে চুষতে চেয়ার টেনে বসে টিস্যু পেপার দিয়ে দাড়িগোঁফ মুছে ক্লাসটিচার যে রকম পড়া থেকে কিছু ব্যাখ্যা করতে বলেন এ রকম ভঙ্গিতে জানতে চান, ‘ তুমি ইন্ডিয়ার লোক নাকি নেপালের?’ আমি ‘বাংলাদেশের’ জবাব দিলে অবাক না হয়ে আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘প্যারিস পর্যন্ত তো সহিসালামতে এসে পৌঁছেছ, অত দুশ্চিন্তা কিসের? অনেক বড় নগর এটি, এখানে নার্ভাস হওয়ার কিছু নেই। নাউ এক্সপ্লেইনট ইট টু মি… কোন রুট ধরে- কোন কোন দেশ পাড়ি দিয়ে এখানে এসে পৌঁছলে?’ শিক্ষকের মতো শানানো দৃষ্টিতে আলগালি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। তার চোখের সম্মোহনকে আমি অবজ্ঞা করতে পারি না। মিনমিন করে বলি, ‘কাজ করছিলাম সিয়েরা লিওনে, বেলজিয়াম হয়ে প্যারিসে মাত্র এসে পৌঁছলাম।’ তিনি একটু অধৈর্য হয়ে জানতে চান, ‘সিয়েরা লিওনের আগে কোথায় ছিলে?’ আমি বিরক্ত হয়ে বলি, ‘কাবুল, আফগানিস্তান।’ শোনামাত্র চাকুস করে আইসক্রিম বারের গলতে থাকা মিষ্টান্ন চুষে ডান হাতে স্যালুটের কৃত্রিম ভঙ্গি করে বলেন, ‘কাবুল ঘেঁটে এসেছ তুমি, ইউ উইল ডু জাস্ট ফাইন ইন প্যারিস। এখানে প্রচুর বাংলাদেশি ফুর্তিতে কাজকর্ম করে বেড়াচ্ছে, তুমি চাইলে আমি তাদের সাথে তোমার যোগাযোগ করিয়ে দেব। ম্যান, দিস ইজ ইউরোপ, ইউ আর নট এলোন হিয়ার। আমরা সকলেই কোনো না কোনো দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে এখানে এসেছি, উই হেল্প ইচ আদার।’

আলগালি মহোদয়ের অ্যাপ্রোচ খুবই আন্তরিক। প্যারিসে আমি অভিবাসী হতে আসিনি, সাহায্যেরও আপাতত কোনো জরুরত নেই, তবে তার ব্যাপারে আমি তীব্র কৌতূহল বোধ করি। তাই সরাসরি জানতে চাই, ‘সুদানের জাবেল মাররা থেকে বের হলেন কীভাবে জনাব আলগালি?’ তিনি আইসক্রিমের কাঠি টিস্যু পেপারে মুড়ে রেখে ম্লান হেসে বলেন, ‘পৈতৃক ভিটায় আর আমার ফিরে যাওয়া হয়নি। কয়েক রাত পাহাড়েই শুয়ে-বসে কাটাই। গ্রাম থেকে আরও দু’চারজন পালিয়ে এসে আমার সাথে যোগ দেয়। জানতে পারি, ওখানে ফিরে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। যারা ছিল আপনজন, তাদের কেউ আর বেঁচে নেই, ঘরদুয়ারও পুড়ে খাক হয়েছে। গুজব রটে যে, জানজায়িদরা ডিংকা যুবকদের ধরে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে তাদের গোত্রের আরব ডাক্তার দিয়ে শরীর থেকে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে বিক্রি করে দিচ্ছে লেবানিজ কিডনি ব্যবসায়ীদের কাছে। তো আমরা মরুভূমির ওপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করি উত্তর দিক নিশানা করে। মাসের পর মাস হেঁটে নীল নদ পাড়ি দিয়ে এসে পৌঁছাই মিসরে। ওখানে ঠাঁই হয় না আমাদের, কারণ আমরা কৃষ্ণ গাত্রবর্ণের অনারব পুরুষ। পুলিশের ধাওয়া এড়াতে ঢুকে পড়ি সিনাই পেনিনসুলাতে।’

জনাব আলগালি একটু বিরতি নিয়ে ফতুয়ার পকেট থেকে তসবি বের করে বলেন, ‘অনেক দেশ ঘোরা হলো, আমাদের গতরের বর্ণ কালো বলে আরবরা আমাদের মুসলমান হিসেবে ট্রিট করতে চায় না। দারফুর থেকে আমি খালি হাতে পথে নামি, সাথে শুধু এ তসবিটুকু নিয়ে এসেছি, মাঝে মাঝে এটা ছুঁয়ে আল্লাহ রাব্বুল আল আমিনের নাম নেই, তাঁর ইচ্ছা হলে আবার হয়তো ফিরতে পারব দারফুরে।’ তার কথাবার্তায় একটু খেই হারানোর ভাব এলে আমি আবার সূত্র ধরিয়ে দেই, বলি, ‘জনাব আলগালি, সিনাই থেকে অতঃপর গেলেন কোথায়?’ তিনি জবাব দেন, ‘বেদুইনরা আমাকে বন্দি করে চোরাচালানের কাজে শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করে। আমাকে দিয়ে সুড়ঙ্গ খোদায়- যার ভেতর দিয়ে তারা প্যালেস্টাইনের গাজা স্ট্রিপে মালমাত্তা পাচার করত। ক্লান্ত হয়ে কাজ করতে না চাইলে তারা আমার সাথে এমন ব্যবহার করত, চাবুক দিয়ে এমন নির্মমভাবে জুলুম করত, কী বলব, মানুষ কিন্তু এ রকম পোষা গাধার সাথেও করে না; তো একদিন পালানোর সুযোগ এলো, আর আমি সীমান্ত অতিক্রম করে ঢুকে পড়লাম ইসরায়েলে।’

জনাব আলগালি এবার দম নিয়ে দ্রুত কোনো দোয়াদরুদ পড়ে তসবির পাথরগুলো মুঠো করে চোখে ঠেকিয়ে ফিসফিসিয়ে জানতে চান, ‘ব্যাগে করে ওয়েস্ট আফ্রিকা থেকে কিছু নিয়ে এসেছ কি? আমি ইমানদার লোক, আমার ওপর বিশ্বাস রাখতে পার, কিছু যদি পাচার করতে চাও, আমি যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারি।’ আমি যে আদতে ইবোলাতাড়িত পর্যটক- এ বিষয়টা তাকে কীভাবে বুঝিয়ে বলি? আমার কোনো দ্রব্য পাচারজনিত ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য নেই। ব্লিজার্ডের তাড়া খাওয়া মরালের মতো আমি উড়ে যাচ্ছি ভিন্ন দেশে। সুদানের এ ভদ্রলোক কি আমাকে স্মাগলার সাব্যস্ত করলেন? মনে মনে ঈষৎ বিরক্ত হলেও কৌতূহল নিবৃত না করে তার সাথে বাতচিতের সমাপ্তি টানতে চাই না। তাই বলি,’ ইসরায়েলে আপনার দিনকাল কীভাবে কাটল জনাব আলগালি?’ আমি তার সওয়ালের সরাসরি জবাব দেইনি বুঝতে পেরে তিনি একটু উত্ত্যক্ত হয়ে বলেন, ‘হারামজাদারা আমাকে ঘেঁটি ধরে নাগেব ডেজার্টে পাঠিয়ে ওখানকার কুখ্যাত হটট ডিটেনশন সেন্টারে বন্দি করে রাখে বছর দেড়েক। তারপর স্পেশাল প্লেনে চড়িয়ে আমার মতো আরও অনেককে ডিপোর্ট করে নামিয়ে দেয় রুয়ান্ডার এক নির্জন মিলিটারি এয়ারপোর্টে। রুয়ান্ডানরা অন্যান্য কারাবন্দির সাথে আমাকে খনির ভেতর পাথর খোঁড়ার কাজে লাগায়। এগারো মাস খনিতে কাজ করার পর সুযোগ আসে পালানোর।’ তিনি আবার হাতে তসবি তুলে নিলে আমি সরাসরি প্রশ্ন করি, ‘তা ফ্রান্সে এলেন কীভাবে জনাব?’ অঙ্ক ভুল করা ছাত্রের ওপর চটে ওঠা শিক্ষকের মতো তিনি একটু তেড়েফুঁড়ে জবাব দেন, ‘বোটে চড়ে, সমুদ্রে এক পর্যায়ে ফুয়েল শেষ হয়ে গেলে বোট ভেসে চলে তিন দিন চার রাত। পানীয় জল কিছু ছিল না। নেভাল পেট্রোলের গানবোট আমাদের উদ্ধার করে।’

জনাব আলগালির কথা বলার উৎসাহ কমে আসে। তিনি কবজিতে বাঁধা রিস্টওয়াচে টাইম দেখেন। তখনই খেয়াল করি, প্ল্যাটফর্মের কাচ চুয়ে আসা রোদে দাঁড়িয়ে পিনেলোপে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মোজাইক করা ফ্লোরে পড়েছে তার চমৎকার ফিগারের ছায়া। আমার দিকে চোখাচোখি হতেই সে সাবলীলভাবে কাছে চলে এসে জনাব আলগালির কাছে ফরাসি ভাষায় মাফ চেয়ে বলে, ‘সরি, তোমাদের গল্পগুজবে ইন্টারাপ্ট করার জন্য খুবই দুঃখিত। মঁশিয়ো সুলতান, তোমার সাথে একটা বিষয়ে আমার বোঝাপড়া বাকি থেকে গেছে, তোমার কোনো আপত্তি না থাকলে বিষয়টা আমি এখনই নিষ্পত্তি করতে চাই।’ তার চোখমুখের সিরিয়াসনেসের দিকে চেয়ে আমি মনে মনে একটু ভড়কে গিয়ে বলি, ‘হোয়াট দ্য হেল আর ইউ টকিং অ্যাবাউট, লোপা?’ জনাব আলগালি কপালের কাটা দাগ কুঁচকে উঠে পড়েন। আমি তাকে ‘মা আসসালাম’ বলে গুডবাই জানাই। বিড়বিড়িয়ে ‘ওয়াল্লা সাওউফ তোসেডুক’ বা ‘আল্লাতালা তোমার মঙ্গল করুন’ বলে তিনি কপিশপ থেকে বেরিয়ে যান। সাথে সাথে তার চেয়ারখানিতে ঝপ করে বসে পড়ে লোপা আমার দিকে ফিচেল ভঙ্গিতে হাসে। আমি তাকে সরাসরি এনকাউন্টার করার মেজাজ নিয়ে বলি, ‘হোয়াট ইজ দ্য ম্যাটার লোপা?’ মুখের ফিচেল হাসিতে মাধুর্য মিশিয়ে আনুনাসিক স্বরে সে জবাব দেয়, ‘তোমার সাথে আমার আনফিনিশড বিজনেস হচ্ছে… কী বলব, ইউ গেইভ মি আ ভেরি সুইট গুডবাই কিস। তারপর প্রতিদানের কোনো সুযোগ না দিয়ে তাড়াহুড়া করে চলে গেলে ব্যাগট্যাগ গোছাতে। ট্রেন থেকে নেমে আমি তো কেবলই তোমাকে খুঁজছি।’ গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমি তার বচনের সত্যতা যাচাই করার চেষ্টা করি। সে খানিক দ্বিধা নিয়ে বলে, ‘প্যারিস স্টেশনে তুমি প্রথমবার এসেছ, আমি তো এখানে প্রায়ই আসি, যার সাথে বসেছিলে, এ ধরনের কিছু আফ্রিকান লোক পর্যটকদের প্ররোচনা দিয়ে আন্ডার ওয়ার্ল্ডের সাঙাতদের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। তারা তখন নানা ধরনের ট্র্যাপে পড়ে। এ লোকের সাথে তোমার কথাবার্তা বলাটা আমার ভালো ঠেকেনি।’

তার বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনে আমি বলি, ‘অলরাইট লোপা, আমি এবার একটু ভিনটেজ হোস্টেলের দিকে যেতে চাচ্ছি, জায়গাটা তুমি চেনো কি?’ আমাকে উঠে পড়ার ইশারা দিয়ে সে জানায়, ‘ভিনটেজ হোস্টেলের অবস্থান এখান থেকে মাত্র দুই ব্লক দূরে।’ লোপা এবার আমার হাত মুঠো করে তা দিয়ে তার কটিদেশ পেঁচাতে পেঁচাতে নরম স্বরে জানতে চায়, ‘ডু ইউ মাইন্ড ওয়াকিং উইথ মি আ বিট? হাঁটতে হাঁটতে মিনিট সাতেকে পৌঁছে যাব ওখানে।’ স্কার্টের সফট সাটিনে তৈরি আবরণ ভেদ করে তার দেহের পেলব তন্তু পুষ্পস্তবকের মসৃণতা নিয়ে স্পর্শ করে আমার করতল। ভাবি, জনাব আলগালির হাত থেকে না হয় রেহাই পেলাম, কিন্তু খামোকা এ নারীর দেহ-সংলগ্ন হয়ে রাজপথে দিবালোকে হাঁটাচলা কতটা নিরাপদ হবে।

সুত্র:সমকাল, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯


About the Author

RailNewsBD
রেল নিউজ বিডি (Rail News BD) বাংলাদেশের রেলের উপর একটি তথ্য ও সংবাদ ভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল।

Comments are closed.