শিরোনাম

অল্প বগি নিয়ে চলছে ট্রেন, কমছে আয়

বগির চাহিদা থাকলেও কর্মকর্তাদের সাড়া নেই

শিপন হাবীব :
রেলওয়ের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে আন্তঃনগর, মেইল ও লোকাল ট্রেনগুলো নির্ধারিত বগির চেয়ে অল্প বগি নিয়ে চলাচল করছে। এতে মাসে সাড়ে চার কোটি টাকা কম আয় হচ্ছে। আবার যাত্রীরাও সেবা বঞ্চিত হচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ট্রেনগুলোতে পর্যাপ্তসংখ্যক বগি সংযোজন করা হলে বছরে শত কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। তারা বলেন, অল্প বগি নিয়ে ট্রেন চলাচল করায় দিনে আয় কমছে প্রায় ১৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা। অথচ চলাচল যোগ্য প্রায় শতাধিক যাত্রীবাহী বগি অলস পড়ে আছে।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন যুগান্তরকে জানান, যাত্রী চাহিদা অনুযায়ী ট্রেনগুলোতে বগি সংযুক্ত করা হচ্ছে। আন্তঃনগর ট্রেনের প্রায় সবক’টি পর্যাপ্ত বগি নিয়ে চলাচল করছে। তিনি বলেন, রেল যোগাযোগ আধুনিক করা হচ্ছে। আরও নতুন বগি ও ইঞ্জিন আনা হচ্ছে। ফলে সমস্যা থাকবে না। নতুন ট্রেনের সঙ্গে বগির সংখ্যাও বেড়েছে। নিশ্চিত করা হচ্ছে যাত্রী সেবা ও নিরাপত্তা। তিনি আরও বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে নেয়া উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সমাপ্ত হলে রেলওয়েতে আমূল পরিবর্তন হবে। রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মো. হাবিবুর রহমান জানান, ২০০১ সাল থেকে অধিকাংশ আন্তঃনগর ট্রেন কম বগি দিয়ে চালানো হয়েছে। কম বগি নিয়ে ট্রেন চালানোয় লাখ লাখ টাকা কম আয় হচ্ছে স্বীকার করে তিনি বলেন, ৯৩টি আন্তঃনগর ট্রেনের মধ্যে চারটি ট্রেন কম বগি নিয়ে চলছে। অপরদিকে, ৩৭৬টি লোকাল ও মেইল ট্রেনের মধ্যে ২৪২টি কম বগি নিয়ে চলাচল করছে। তবে আন্তঃনগর, লোকাল ও মেইল ট্রেনগুলো পর্যাপ্তসংখ্যক বগি নিয়ে চলাচল করলে বছরে শত কোটি টাকা বেশি আয় হতো বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ২ বছর আগে ভারত ও ইন্দোনেশিয়া থেকে ১৭০টি নতুন বগি আনা হয়েছে। তবে, সেগুলোর যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না।

অভিযোগ, বেসরকারি ট্রেনে পর্যাপ্তসংখ্যক বগি দেয়া হলেও সরকারি ট্রেনগুলো চলছে স্বল্প বগি নিয়ে। ২৪২টি লোকাল ও মেইল ট্রেন গড়ে দিনে চারটি করে কম বগি নিয়ে চলাচল করায় প্রতিদিন ৯৬৮টি বগি কম ব্যবহার করা হচ্ছে। বেশ কয়েকজন সংশ্লিষ্ট রেলওয়ে কর্মকর্তা জানান, পর্যাপ্তসংখ্যক বগি নিয়ে ট্রেন চালানোর পরামর্শ ও চাহিদার কথা বলা হলেও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাড়া মেলে না। ফলে নতুন বগি সংযোগ ও নতুন ট্রেন পরিচালনা করেও লোকসান গুনতে হচ্ছে রেলওয়েকে।

বর্তমানে পূর্বাঞ্চলে চলাচলকারী তূর্ণা নিশীথা এক্সপ্রেস, মহানগর গোধূলি, কালনী এক্সপ্রেস ও পশ্চিমাঞ্চলে চলাচলকারী রাজশাহী এক্সপ্রেস ১৪ জোড়া অর্থাৎ ২৮টি বগি কম নিয়ে চলাচল করছে। এর মধ্যে কালনী এক্সপ্রেসে সাত জোড়া, রাজশাহী এক্সপ্রেসে তিন জোড়া, তূর্ণা নিশীথা এক্সপ্রেসে দুই জোড়া এবং মহানগর গোধূলি এক্সপ্রেসে দুই জোড়া বগি কম ব্যবহার করা হচ্ছে।

রেলওয়ে বাণিজ্যিক শাখা সূত্রে জানা যায়, বছরের পর বছর কম বগি নিয়ে চলা ঢাকা-সিলেটগামী কালনী এক্সপ্রেস থেকে প্রতি বছর ১২ কোটি ৮৫ লাখ ২০ হাজার টাকা আয় কম হচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রামগামী নিশিথা ও মহানগর গোধূলি এক্সপ্রেস থেকে বছরে ৯ কোটি ৪ লাখ ৪৬ হাজার ৮০০ টাকা ও ঢাকা-চাঁপাইনবাগঞ্জগামী রাজশাহী এক্সপ্রেস থেকে বছরে ৬ কোটি ৬৭ লাখ ৪৪ হাজার টাকা কম আয় হচ্ছে। এছাড়া ২৪২টি লোকাল ও মেইল ট্রেন থেকে বছরে অন্তত ২৫ কোটি টাকা আয় কম হচ্ছে। প্রতিটি লোকাল ও মেইল ট্রেন ৮ থেকে ১০টি বগি নিয়ে চলাচল করার কথা থাকলেও ৪ থেকে ৫টি বগি নিয়ে চলাচল করছে। অপরদিকে, বেসরকারি খাতে চলাচলকারী লোকাল ও মেইল ট্রেনগুলো ৭ থেকে ১০টি বগি নিয়ে চলাচল করছে। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের সেন্ট্রাল কন্ট্রোল (রাজশাহী) কর্মকর্তা মো. কামরুল ইসলাম জানান, পশ্চিমাঞ্চলে ৫৬টি মেইল ও ৪৭টি লোকাল ট্রেন কম বগি নিয়ে চলাচল করছে। কিছু ট্রেনে আন্তঃনগর ট্রেনের পুরাতন বগি লাগানো হয়েছে। তিনি বলেন, প্রায় দুই যুগ ধরে মেইল ও লোকাল ট্রেনের বগি আমদানি করা হয়নি। স্থানীয় ওয়ার্কশপগুলোতে মেরামত করা বগি দিয়ে ট্রেনগুলো চালানো হচ্ছে। চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ জানান, চট্টগ্রাম-ঢাকাগামী তূর্ণা নিশীথা ও মহানগর এক্সপ্রেস ৪ জোড়া অর্থাৎ ৮টি বগি কম নিয়ে চলাচল করছে। এছাড়া চট্টগ্রাম থেকে চলাচলকারী সবক’টি লোকাল ও মেইল ট্রেন কম বগি নিয়ে চলাচল করছে। এতে যেমন রাজস্ব আয় কম হচ্ছে, তেমনি যাত্রীরা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

সিলেট রেলওয়ে স্টেশন ম্যানেজার মো. কাজী শাহিদুর রহমান জানান, এ পথে যাত্রী চাপ সব সময় বেশি থাকে। ২০১২ সালে ঢাকা-সিলেট রুটে কালনী এক্সপ্রেস ১৬টি বগি নিয়ে চলাচল শুরু হয়। এরপর দিন দিন কমতে থাকে ট্রেনটির বগির সংখ্যা। কখনও চারটি, কখনও পাঁচটি বগি নিয়ে ট্রেনটি চলাচল করছে। প্রতিদিন ট্রেনটি ৭ জোড়া বগি কম নিয়ে চলাচল করায় ৮৪০ জন যাত্রী বঞ্চিত হচ্ছেন। তিনি বলেন, এ রুটে সবক’টি লোকাল ও মেইল ট্রেন কম বগি নিয়ে চলাচল করছে। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট মো. বেলাল উদ্দিন জানান, এ রুটে চলাচলকারী আন্তঃনগর ট্রেনগুলোতে নতুন বগি সংযুক্ত করা হয়েছে। রেলপথমন্ত্রীর নির্দেশনায় সবক’টি ট্রেনেই পর্যাপ্ত বগি সংযুক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে চাঁপাইনবাগঞ্জ-ঢাকা রুটে চলা রাজশাহী এক্সপ্রেস তিনটি বগি কম নিয়ে চলছে। লোকাল ও মেইল ট্রেনগুলোও কম বগি নিয়ে চলাচল করছে।

পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে চলাচলকারী যাত্রীরা জানান, আন্তঃনগর ট্রেনগুলোতে সব সময় যাত্রী চাপ থাকে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে চলাচলকারী যাত্রী খন্দকার আতিকুল ইসলাম জানান, ব্যবসার কাজে তাকে প্রতি সপ্তাহে অন্তত দু’বার চট্টগ্রামে যেতে হয়। প্রায় সময় কাউন্টারে টিকিট পাননি। বাধ্য হয়ে কালোবাজারির কাছ থেকে দ্বিগুণ টাকা দিয়ে টিকিট কাটতে হয়।

রেলপথ মন্ত্রণালয়, পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০০১ সালের পর রেলওয়েতে নতুন বগি ও ইঞ্জিন আনা বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৯ সালে নতুন বগি ও ইঞ্জিন কেনার জন্য দুটি দেশের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। দুই বছর আগে ১৭০টি নতুন বগি আনা হয়েছে। ওই সব বগি দিয়ে নতুন ট্রেন চালানোসহ কম বগি নিয়ে চলা ট্রেনগুলোতেও বগি সংযুক্ত করা হয়েছে।

রেলওয়েতে দক্ষ শ্রমিক রয়েছে জানিয়ে জাতীয় রেলওয়ে শ্রমিক লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবীর জানান, শূন্যপদগুলোতে নিয়োগ দিয়ে দক্ষ জনবল তৈরি করতে পারলে দেশেই বগি তৈরি সম্ভব। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে কেউ তেমন ভাবছেন না। ওয়ার্কশপগুলোতে প্রায় ৫০ শতাংশ শূন্যপদ রয়েছে, যা পূরণ করা জরুরি। তবে অবহেলিত এ রেলকে অত্যাধুনিক করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ করছেন। বুলেট ট্রেন চালানোরও প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে ।

সুত্র:দৈনিক যুগান্তর,১৬ অক্টোবর, ২০১৭


About the Author

RailNewsBD
রেল নিউজ বিডি (Rail News BD) বাংলাদেশের রেলের উপর একটি তথ্য ও সংবাদ ভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল।

Comments are closed.