শিরোনাম

রেলওয়ের অনুমতি ছাড়াই লেভেল ক্রসিং স্থাপন এলজিইডির

রেলওয়ের অনুমতি ছাড়াই লেভেল ক্রসিং স্থাপন এলজিইডির

শামীম রাহমান :বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্ব ও পশ্চিম—দুই অঞ্চল মিলে রেলপথ আছে ৩ হাজার ১৯ কিলোমিটার। রেলের এ নেটওয়ার্কে অনুমতি না নিয়ে ১ হাজার ১৪৯টি লেভেল ক্রসিং গড়ে তুলেছে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান। অনুমোদনহীন এমন লেভেল ক্রসিং নির্মাণে সবচেয়ে এগিয়ে আছে সরকারি সংস্থা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। সব মিলিয়ে সংস্থাটি রেলপথের ওপর গড়ে তুলেছে পাঁচশর বেশি অবৈধ লেভেল ক্রসিং। যদিও গেটম্যানসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাবে অনুমোদনহীন এসব ক্রসিংয়ে নিয়মিতই ঘটছে দুর্ঘটনা। বাংলাদেশ রেলওয়ের পরিসংখ্যানই বলছে, ২০০৮-২০১৮ সময়ে লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের সঙ্গে বিভিন্ন যানবাহনের সংঘর্ষে মৃত্যু হয়েছে ২৬৩ জনের।

আইন অনুযায়ী, রেলপথে লেভেল ক্রসিং নির্মাণের আগে বাংলাদেশ রেলওয়ের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। অনুমতি পাওয়া গেলে রেলওয়ের তত্ত্বাবধানে নির্মাণ করতে হয় লেভেল ক্রসিং। তবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন না নিয়ে ৫১৬টি লেভেল ক্রসিং বানিয়েছে এলজিইডি। এর মধ্যে ৩৩২টিই বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে। পশ্চিমাঞ্চলে আছে অনুমোদনহীন বাকি ১৮৪টি লেভেল ক্রসিং। বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলো বানানোর সময় এর কোনোটিই করেনি এলজিইডি। শুধু রেললাইনের ওপর দিয়ে রাস্তা পার করিয়েই দায় সেরেছে সংস্থাটি। যানবাহন থামানোর জন্য গেট কিংবা গেটম্যান—রাখা হয়নি কোনোটিই। নেই সতর্কতামূলক সাইন/সিগন্যালও, যা তৈরি করছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি।

অনুমোদন না নিয়ে অবৈধভাবে গড়ে তোলা লেভেল ক্রসিংগুলো দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে মনে করেন খোদ স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) মেজবাহ উদ্দিন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের গ্রামীণ সড়কগুলোতে অনেক লেভেল ক্রসিং রয়েছে, যেগুলো যথাযথ নিময় মেনে বানানো হয়নি। ফলে মাঝেমধ্যেই এগুলো সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। রেলওয়ের সঙ্গে লেভেল ক্রসিং সম্পর্কিত সমস্যা সমাধানে আমার নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। সারা দেশে এলজিইডির কত অবৈধ লেভেল ক্রসিং আছে, সেগুলো আমরা শনাক্ত করছি। অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোকে কীভাবে একটা সিস্টেমের মধ্যে আনা যায়, এ বিষয়ে আমরা রেলওয়ের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ শুরু করে দিয়েছি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অবৈধ লেভেল ক্রসিং সমস্যার সমাধানে একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করছে এলজিইডি। বাংলাদেশ রেলওয়ের অনুমতি নিয়ে বা অনুমতি ছাড়া এলজিইডির যেসব লেভেল ক্রসিং বানানো হয়েছে, সেগুলোয় রেলগেট, গুমটি ঘর নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় নির্বাহ করা হবে এ প্রকল্পের মাধ্যমে। পাশাপাশি এলজিইডি নতুন যেসব সড়ক নির্মাণ করবে, সেগুলোয় যদি লেভেল ক্রসিং দেয়ার প্রয়োজন হয়, তাহলে সেই কাজটি যথাযথ নিয়ম মেনে করার কথা বলছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা।

এলজিইডি ছাড়াও আরো আট সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার আওতাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রেলপথে বিপুলসংখ্যক অবৈধ লেভেল ক্রসিং বানিয়ে রেখেছে। এর মধ্যে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের ১১টি, ইউনিয়ন পরিষদের ৩৬৩টি, পৌরসভার ৭৯টি, সিটি করপোরেশনের ৩৪টি, জেলা পরিষদের ১৩টি, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তিনটি, বেনাপোল স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের একটি, জয়পুরহাট চিনিকল কর্তৃপক্ষের একটি অবৈধ লেভেল ক্রসিং নির্মাণ করা হয়েছে। এর বাইরে বেসরকারি উদ্যোগে তিনটি, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ৯২টি ও ৩৩টি এমন অবৈধ লেভেল ক্রসিং রয়েছে, যেগুলোর মালিকানা আসলে কার, তা এখনো চিহ্নিত করতে পারেনি বাংলাদেশ রেলওয়ে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের অনুমোদিত লেভেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা ১ হাজার ৪১২টি। এর মধ্যে গেটম্যান আছে মাত্র ৪৪৬টি লেভেল ক্রসিংয়ে। জনবলের অভাবে এখনো গেটম্যানবিহীন রেলের ৬৮ শতাংশের বেশি লেভেল ক্রসিং। লেভেল ক্রসিংয়ের রেলগেট ওঠানো-নামানোর দায়িত্বে থাকেন গেটম্যান। গেটম্যান না থাকায় ৯৬৪টি বৈধ লেভেল ক্রসিং সুরক্ষা-নিরাপত্তার দিক দিয়ে তাই অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোর কাতারেই রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

অনুমোদিত ও অননুমোদিত মিলে দেশে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা ২ হাজার ১১৩। বিপুলসংখ্যক লেভেল ক্রসিং অরক্ষিত থাকায় প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্য বলছে, ২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এগারো বছরে লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩৯৭টি। এসব দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ২৬৩ জনের। লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় ২০১৪ সালে। ৩৪টি দুর্ঘটনায় ওই বছর মারা যান ৫৪ জন। অন্যদিকে সবচেয়ে কম মৃত্যু হয় ২০১৭ সালে। সে বছর ১৫টি দুর্ঘটনায় একজনের মৃত্যু হয়।

বিপুলসংখ্যক বৈধ লেভেল ক্রসিং অরক্ষিত থাকার কারণ হিসেবে জনবল সংকটের কথা বলছেন বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, জনবলের অভাবে অনেক বৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে গেটকিপার রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তবে গেটকিপার নিয়োগ ও পদায়নের প্রক্রিয়া চলমান থাকার কথা জানিয়েছেন তারা। অন্যদিকে অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোর সিংহভাগই যেহেতু বিভিন্ন সরকারি সংস্থা বানিয়েছে, সেহেতু সেগুলোর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের বদলে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের কথা বলছেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা। দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমিয়ে আনতে লেভেল ক্রসিংয়ের সড়কে গতিরোধক দেয়ার কথাও বলছেন তারা। গতিরোধক বসানো নিয়ে গতকাল রেলভবনে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভাও করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়।

সূত্র:বণিক বার্তা, জানুয়ারি ১১, ২০২১


About the Author

RailNewsBD
রেল নিউজ বিডি (Rail News BD) বাংলাদেশের রেলের উপর একটি তথ্য ও সংবাদ ভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল।

Comments are closed.