।। নিউজ ডেস্ক ।।
নানান ঘটনায় বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল। কখনো রেলওয়ে রানিং স্টাফদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি আবার কখনো মাইলেজ রীতি রহিতকরণ, বাস ট্রেন সংঘর্ষ।
ঐতিহাসিক সবুজ বলয় খ্যাত সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ নিয়ে ছিল নিয়মিত আন্দোলন।
গত ৪ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নগরের খুলশী থানার ঝাউতলা রেলক্রসিংয়ে ডেমু ট্রেনের সঙ্গে বাস-সিএনজির ত্রিমুখী সংঘর্ষের ঘটনায় ট্রাফিক পুলিশের কনস্টেবল মনিরুল ইসলাম, পাহাড়তলী কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী শারতাজ উদ্দিন শাহীন ও ডালি কনস্ট্রাকশনের ইঞ্জিনিয়ার বাহা উদ্দিন সোহাগ মারা যান। এছাড়া আহত হন আরও ছয়জন।
ঝুঁকিপূর্ণ রেললাইন ও সেতু
লেভেল ক্রসিং, ঝুঁকিপূর্ণ রেললাইন ও সেতু ট্রেন দুর্ঘটনার একটি কারণ। প্রতিদিন তিনবার করে পুরো রেললাইন, সিগন্যাল ও সেতু পরিদর্শনের কথা থাকলেও অনেক সময় বছরে একবারও পরিদর্শনে যাওয়া হয় না। দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ, লাইনচ্যুত হয়ে ও লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা ঘটছে। সারা দেশে আছে ৩ হাজার ৬টি রেল সেতু, যার ৯০ শতাংশ তৈরি হয়েছে ব্রিটিশ আমলে। জোড়াতালি দিয়ে সচল রাখা হয়েছে সেতুগুলো। এগুলোর ওপর দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে চলছে বিভিন্ন রুটের ট্রেন।
রেললাইনে পাথর না থাকা, সিগন্যাল ব্যবস্থার ত্রুটি, লাইন ক্ষয়, স্লিপার নষ্ট, লাইন ও স্লিপার সংযোগস্থলে লোহার হুক না থাকার কারণেও ঘটছে দুর্ঘটনা। লাইনে নির্ধারিত দূরত্বের মধ্যে (প্রায় ৪০-৫০ ফুট) পয়েন্ট রয়েছে। এসব পয়েন্টের মধ্যে দুইপাশে ৮টি করে মোট ১৬টি নাট-বল্টুসহ ১৬টি হুক, ক্লিপ থাকার কথা। কিন্তু অধিকাংশ পয়েন্টের মধ্যে ১৬টির স্থলে রয়েছে ৫-৭টি ।
ব্রিটিশ আমলের রেল সেতু, মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন কোচ, জরাজীর্ণ রেললাইন ও লোকবলের ঘাটতি নিয়ে কথা হয়েছে সংসদে। দেশের প্রায় ৩ হাজার ৩৩২ কিলোমিটার রেলপথের বিভিন্ন স্থানে প্রায় সময় খোলা থাকে ফিশপ্লেট, ক্লিপ, হুক, নাট-বল্টুসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ। এমনকি রেললাইন মজবুত ও স্থিতিশীল রাখতে স্থাপিত স্লিপারগুলোর অবস্থাও নাজুক। আবার এসব স্লিপারকে যথাস্থানে রাখতে যে পরিমাণ পাথর থাকা প্রয়োজন অধিকাংশ স্থানে তা নেই। কোথাও কোথাও পাথরশূন্য অবস্থায় আছে স্লিপারগুলো।
প্রতিদিন রেললাইন, সিগন্যাল ও ব্রিজ পরিদর্শন করা ছাড়াও ট্রেন ছাড়ার পূর্বে ইঞ্জিন ও প্রতিটি বগির চাকাসহ বিশেষ বিশেষ যন্ত্রাংশ চেক করার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না।
লোকবল সংকট
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে লোকবল সংকট দীর্ঘদিনের। পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। শূন্য রয়েছে ৭ হাজার ৯৯ জনের পদ। ২৪৫ জন সহকারী স্টেশন মাস্টার নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল রেলওয়ে। কিন্তু তাদের চাকরিও নানান কারণে অনিশ্চিত। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পদ রয়েছে ১১টি। কিন্তু সেখানে আছেন মাত্র ৫ জন। এছাড়াও বিভিন্ন দফতরে লোকবল সংকট থাকায় সঠিক কাজ যথাসময়ে হচ্ছে না বলে অভিযোগ কর্মকর্তাদের। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে লোকবল বাড়ানোর জন্য বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন কোচ
মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিনের কারণেও দুর্ঘটনায় পড়ছে ট্রেন। দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেন থেকে ১০টি নিম্নমানের ইঞ্জিন এনে সমালোচনার মুখে পড়ে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। সেই সমালোচনার তোয়াক্কা না করেই গত ২১ নভেম্বর আরও ১০টি ইঞ্জিন একই কোম্পানি থেকে আমদানি করে রেলওয়ে। সেই নতুন ইঞ্জিনগুলো বহরে যুক্ত হতে না হতেই ৩টি অকেজো হয়ে গেছে।
এছাড়াও গত ১৪ ডিসেম্বর কোরিয়ার হুন্দাই কোম্পানি থেকে আমদানি করা নতুন ১০টি ইঞ্জিনের মধ্যে ৩০১৪ সিরিয়ালের একটি ইঞ্জিন টার্ন টেবিল থেকে অসতর্কতা ও অদক্ষতার কারণে পড়ে যায়।
রেলপথে মৃত্যু
ট্রেনের ছাদে উঠে কিংবা এক বগি থেকে অন্য বগিতে লাফিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করার সময় নিচে পড়ে কাটা পড়ে মৃত্যু হয় অনেক পথশিশু ও ভবঘুরের। ৩০ অক্টোবর নগরের কদমতলী রেলগেট এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়গামী শাটল ট্রেনে কাটা পড়ে মনুজা বেগম (৭০) নামে এক ভিক্ষুকের মৃত্যু হয়। ৯ অক্টোবর জোরারগঞ্জে ট্রেনে কাটা পড়ে অজ্ঞাতনামা (২২) এক যুবকের মৃত্যু হয়। ৫ অক্টোবর হাটহাজারীর মীরেরহাট ইউনিয়নের আলমপুর এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় আব্দুস সোবহান (৭৫) নামে এক বৃদ্ধ মারা যান। বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে এসে সীতাকুণ্ড রেলস্টেশনে ট্রেনে কাটা পড়ে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় আরও দুজন আহত হয়। ৯ সেপ্টেম্বর সকালে সীতাকুণ্ড রেলস্টেশনে ট্রেনের ধাক্কায় তিনি মারা যান। গত ৩১ অক্টোবর লাফাতে গিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শাটল ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে বালুছড়া এলাকায় ১০ বছরের এক পথশিশু মারা যায়। গত ৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বর গেট এলাকায় রেল ক্রসিংয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে অজ্ঞাত যুবকের দু পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এছাড়াও সর্বশেষ গত ২৪ ডিসেম্বর হাটহাজারীর মীরেরহাট বাজারের রেল ক্রসিংয়ের উত্তরে ট্রেনে কাটা পড়ে রাউজানের এক তরুণের মৃত্যু হয়েছে।
মাইলেজ রীতি
সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রেলওয়ে ট্রেন চালকদের (রানিং স্টাফ) যে অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয় সেটিকে ব্রিটিশ আমল থেকে মাইলেজ বলা হয়। এছাড়াও রেলওয়ে রানিং স্টাফরা প্রতি ৮ ঘণ্টা কর্ম সম্পাদনের জন্য ১ দিনের মূল বেতনের সমপরিমাণ যে অর্থ দেওয়া হয় তাই মাইলেজ।
রেলওয়ের সংস্থাপন কোডের বিধানের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ রেলওয়ের ট্রাফিক রানিং স্টাফ এবং লোকোমোটিভ রানিং স্টাফদের ১৯৯৭ সালের ১ জুলাই থেকে মূল বেতনের ভিত্তিতে রানিং অ্যালাউন্স দেওয়ার প্রস্তাব হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৮ সালের ২৮ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রানিং স্টাফদের বিশেষ এ ভাতা প্রদানের প্রস্তাব অনুমোদন করেন। কিন্তু সম্প্রতি ইএফটির মাধ্যমে বেতন-ভাতা প্রদান প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্তিতে বিশেষ ভাতা সীমিত হয়ে যাওয়ার ঘোষণা মানছেন না রানিং স্টাফরা। এ মাইলেজ পাওয়ার জন্য বছরজুড়ে আন্দোলনে রেলওয়ে রানিং স্টাফরা।
সর্বশেষ ৩ নভেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব শামীম বানু শান্তি স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, চলন্ত ট্রেনে দৈনিক ১০০ কিলোমিটার কিংবা তার চেয়েও বেশি দায়িত্ব পালন করলেও ওই দিনের বেতনের ৭৫ শতাংশের বেশি মাইলেজ ভাতা পাবেন না সংশ্লিষ্ট রানিং স্টাফ। আর মাস শেষে এই মাইলেজ মূল বেতনের বেশি হবে না। এই প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকেই সংশ্লিষ্ট দফতরে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন রেলওয়ের রানিং স্টাফরা।
করোনায় রেলওয়ের ক্ষতি
২০২১ সালে মার্চে করোনার প্রকোপ বৃদ্ধিতে লকডাউন আর যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ হয় গড়ে দিনে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২৬ লাখ টাকা। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে গণপরিবহনের মতো ট্রেনেও অর্ধেক যাত্রী পরিবহনের নির্দেশনা দেওয়া হয়। ১ এপ্রিল থেকে অর্ধেক যাত্রী নিয়েই বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যায় সব যাত্রীবাহী ট্রেন। এভাবে চলে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত। অর্ধেক যাত্রী পরিবহন করায় দিনে পূর্বাঞ্চল রেলে ১৩ লাখ টাকা ক্ষতি হয়। ৫ দিনে ক্ষতি ৬৫ লাখ টাকা। সরকারের পক্ষ থেকে ৫ এপ্রিল থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত লকডাউন ঘোষণা করা হয়। এতে বন্ধ করে দেওয়া হয় সব গণপরিবহন। যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করতে না পারায় ৫ এপ্রিল থেকে দিনে ২৬ লাখ টাকা ক্ষতি রেলের।
সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ
পূর্ব রেলের সদর দফতর চট্টগ্রামের সিআরবি এলাকায় পিপিপিতে একটি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এ হাসপাতাল নির্মাণের খবরে চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষ এর বিরোধিতায় আন্দোলনে নামে। যে আন্দোলন এখনো চলছে।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর সিআরবি এলাকায় বেসরকারি হাসপাতাল নির্মাণ বন্ধ ও বাংলাদেশ রেলওয়ে-ইউনাইটেড হাসপাতালের চুক্তি বাতিলের দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ৯ সংগঠনের উদ্যোগে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়াও গত ২৪ জুলাই সিআরবিতে পিপিপি’র হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজ নির্মাণের চুক্তি বাতিলের দাবিতে চট্টগ্রামের ১০১ বিশিষ্ট নাগরিক বিবৃতি দিয়েছেন।
প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন সংগঠনের আয়োজনে সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের বিরুদ্ধে সমাবেশ করছেন।
সূত্রঃ বাংলানিউজ২৪