শিরোনাম

রেলক্রসিংয়ে বেড়া ডিঙ্গানো থামাবে কে?


।। রেল নিউজ ।।
অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে বার বার মর্মন্তুদ দুর্ঘটনা ঘটছে। একটি দুর্ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আরেকটি ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনার খবর এসে হাজির হচ্ছে। সম্প্রতি হাটহাজারী উপজেলার মীরসরাইয়ে মহানগর প্রভাতী ট্রেন ও পর্যটকবাহী মাইক্রোবাসের সংঘর্ষে ১১ জনের মৃত্যু ছিল খুবই ভয়াবহ ঘটনা। মীরসরাইয়ে একই রেল ক্রসিংয়ে ২০১১ সালে আরেকটি ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনায় বহু প্রাণহানি হয়েছিল। এসব দুর্ঘটনা রেলের দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও নৈরাজ্যের প্রতীক হিসেবে জনমনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক করেছে।

রেললাইনের ওপর মানুষ বা পশুপাখির অবাধ বিচরণ পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে চোখে না পড়লেও আমাদের দেশে রেললাইনের ওপর নিয়মিত কাঁচাবাজার বসে। মানুষ রেললাইনের ওপর হাঁটে, বসে গল্প করে, হাওয়া খায়। ধান, পাট, খড়, কাপড় ইত্যাদি শুকায়। গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি হরদম রেললাইনে ঘোরাফেরা করে। কয়েক বছর আগে রেললাইরে ওপর ঘুমিয়ে পড়েছিল একদল ক্লান্ত মানুষ। রাতের আঁধারে ঘুমন্ত মানুষগুলোর ওপর দিয়ে ট্রেন চলে গিয়ে অকাল মরণ ডেকে এনেছিল বেশ কয়েকজনের।

আমাদের দেশে ২০২২ সালের শেষে এসে এখনও বিদ্যুৎ দিয়ে কোনো ট্রেন চলে না। ফলে রেললাইনে বিদ্যুৎ সম্পর্কিত কোনো সতর্কতা না থাকায় সারাদেশের রেলপথ রয়েছে উন্মুক্ত। এই উন্মুক্ত রেলপথ সবসময় অরক্ষিত এবং দুর্ঘটনা ঘটানোর জন্য অতি সহজ উপায় তৈরি করে রেখেছে।

দেশে ৮২ শতাংশ রেলক্রসিং অরক্ষিত ও অনিরাপদ। সারাদেশে ২৯৫৯ কিলোমিটার রেলপথে ২৮৫৬টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে ১৪৯৫টি বৈধ এবং ১৩৬১টি অবৈধ। ৯৬১টি রেলক্রসিংয়ে কোনো গেটম্যান নেই। এগুলো ২৪ ঘণ্টা উন্মুক্ত থাকে। মানুষ, গাড়ি নিজের দায়িত্ব নিজে নিয়ে ডানে বাঁয়ে একবার তাকিয়ে এসব রেলগেট পার হন। শীতের দিনে ঘন কুয়াশার সময় অথবা কোনো কারণে একটু উদাসীনতায় ঘটে যায় মারাত্মক সংঘর্ষ ও মৃত্যু।

এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশে ২০২০ থেকে ২০২২ সালের ২৮ জুলাই পর্যন্ত মোট ১১৬টি রেল দুর্ঘটনায় ২১৯ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ২০২০ সালে ৩৮টি দুর্ঘটনায় ৬৯ জন, ২০২১ সালে ৪৩টি দুর্ঘটনায় ৭৬ জন এবং ২০২২ সালের জুলাই ২৮ পর্যন্ত ৩৫টি দুর্ঘটনায় ৭৪ জন নিহত হয়েছেন।

আমাদের দেশে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। মারাত্মক কিছু ঘটলে তারপর সবাই সেটা নিয়ে লেখালেখি করে, সরব হয়ে যায় চারদিক। কিন্তু রেলের ক্ষেত্রে মারাত্মক কিছু ঘটে গেলেও রেল কর্তৃপক্ষের কারও টনক নড়ার তেমন কিছু চোখে পড়ে না। তার প্রধান কারণ হলো- রেল সব সময় নিজেদের মনে করে সরকারি কাজে কারও কোনো ক্ষতি হলে সেটা সরকারেরই দায়িত্ব দেখার- রেলের নয়। সেবাদানকারী মানুষগুলো যে সরকারের ভাবমূর্তি বজায় রাখার অংশ তারা সেটা বুঝতে চায় না।

দেশের রেলপথে অননুমোদিত ও অবৈধ বলে যে ১৩৬১টি রেলক্রসিং রয়েছে সেগুলো কার নির্দেশে স্থাপন করা হয়েছে তা বোধগম্য নয়। গেটম্যান ও গেটবার ছাড়া সেগুলো কেন স্থাপন করা হয়েছে সেজন্য কে জবাবদিহি করবেন তাও স্পষ্ট নয়। মনে হয় রেল সেগুলোর দায় নিতে চায় না। তাহলে সেসব গেটে দুর্ঘটনা ঘটলে কি উপায় হবে? ভিকটিম কি কোনো রূপ মামলা করতে পারবে না? ক্ষতিপূরণও পাবে না?

দুর্ভাগ্যবশত কোন মানুষ আহত বা নিহত হলে কারও কাছে ক্ষতিপূরণের জন্য দাবিও করতে পারবে না- তা কেমন করে হয়? তাহলে একটি সভ্য দেশে এমন অসভ্য সেবাদান বা যোগাযোগব্যবস্থা চালু রেখে আমরা কীসের বড়াই করছি? এছাড়া বৈধ সেব রেলক্রসিং রয়েছে সেগুলোতে পর্যাপ্তসংখ্যক গেটম্যান নেই।

যারা আছেন তারা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করেন না। তাদের ঠিকমতো দায়িত্ব পালন তদারকি করার মতো কোনো ব্যবস্থা নেই। অনেক সময় তারা ঘুমিয়ে থাকে, খোলা গেটের ভেতর দিয়ে মানুষ, রিকশা, বাস সবই চলে এবং তার মধ্যে দিয়ে হঠাৎ হুড়মুড় করে দ্রুতগামী ট্রেন চলে যায়। ফলে ঘটে মারাত্মক দুর্ঘটনা।

এসব গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অতন্দ্র প্রহরীর মতো কমপক্ষে দুজনকে দায়িত্ব পালন করার কথা। কিন্তু তা তো নেই। আর আধুনিক যুগে শুধু লোকবল বাড়িয়ে রেলক্রসিং পাহারা দেওয়ার কাজ করা যাবে না। ফোনকল, ফেসবুক ও ইউটিউবে মত্ত মানুষের জন্য ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে রেলগেট পাহারা দেওয়াটা খুব কঠিন ব্যাপার।

তাই রেলক্রসিংয়ের আধুনিকায়ন করতে হলে সর্বপ্রথম সব রেলগেটে বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থা করতে হবে। রেল সিগন্যালিংয়ের অটোমেশন করতে হবে। জাপানের প্রতিটি রেলগেটে স্বয়ংক্রিয় লালবাতি ও কড়াশব্দের ঘণ্টা বেজে ওঠার ব্যবস্থা রয়েছে। রেলগেট থেকে ৪-৫ কি. মি. দূরের লাইনে ট্রেন ঢোকার সাথে সাথে নিকটস্থ প্রয়োজনীয় রেলগেটে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঝলমলে লাল-হলুদ বাতি জ্বলতে থাকে। সেই সঙ্গে বাজতে থাকে কড়া শব্দের ঘণ্টা। এর সাথে রয়েছে গোটা রেলগেট এলাকা সিসি ক্যামেরা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। ও হ্যাঁ, ওদের দেশের গোটা রেলপথের দুদিকে এমনভাবে কাঁটাতার বা নেটের বেড়া দেয়া হয়েছে যেখানে মানুষ বা বন্যপ্রানীর রেললাইনে ওঠের ফুরসৎ নেই।

আমরা হঠাৎ করে ততদূর যেতে না পারলেও কমপক্ষে স্বয়ংক্রিয় ব্লিক করা আলো এবং কড়া ঘণ্টা লাগিয়ে গেটবার ফেলার ব্যবস্থা করতে পারি। এতে মানুষ ও সব ধরনের গাড়ি দ্রুত থেমে যাওয়ার জন্য সংকেত দিতে পারি। আধুনিক মাইক্রেচিপস্ সংবলিত অটো সিগন্যাল তৈরি করা খুব ব্যয়বহুল নয়। তবে মূল বিষয় হলো- এজন্য রেলগেটগুলোতে সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ থাকা জরুরি। সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ না থাকলে তার বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে আপিএস বা চার্জিং ব্যাটারির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

মানুষ নিয়ম মানে না এমন অপবাদের দিন শেষ করতে হবে। মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বেপরোয়া মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার ওষুধ কারও অজানা নয়। আমাদের দেশে সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা দুর্বল অথবা আইন কারও কারও জন্য কঠোর, কারও জন্য শিথিল।

এই দুর্বিপাকে পড়ে মানুষ বড় অস্বস্তিতে দিনাতিপাত করে। আমাদের রাস্তায় চলাচলের আইন এখনও হাতের আঙুলের ইশারায় বন্দি। তাই রেলগেটের আশেপাশে চারদিকে মানব প্রবেশের বিরুদ্ধে শক্ত বেড়া দিয়ে সিসি ক্যামেরা বসিয়ে রেকর্ড করে আইন ভঙ্গকারীকে জরিমানা ও কঠিন শাস্তি দিতে হবে। বিদ্যুৎ না থাকলে সোলার প্যানেল বসিয়ে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালের মাধ্যমে অটোমেশন ব্যবস্থা চালু করতে হবে।

রেলক্রসিংয়ের সামনে আসা মাত্র অনেকে তাড়াহুড়ো করে পার হওয়ার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। নতুন ড্রাইভার বা গাড়িওয়ালারা বেশ অধৈর্য হয়ে ওঠে। তারা জানে না যে, রেল ইঞ্জিনের মতো বড় কোনো যন্ত্রের নির্দিষ্ট কাছে এলে অন্য যে কোনো ছোট ইঞ্জিনের কার্যকারিতা এমনিতেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

সম্প্রতি ভারতে রেলক্রসিং দুর্ঘটনার ওপর এক গবেষণায় এমন ভয়ংকর তথ্য বের হয়ে এসেছে। ফলে নতুন গাড়িকে লাইনে ওঠামাত্র হঠাৎ স্টার্ট বন্ধ হয়ে যেতে দেখা যায়। এই অজ্ঞতার ফলে অনেককে রেললাইনে ওঠে যাওয়ার পর গাড়ি বন্ধ হয়ে যাওয়া ইঞ্জিনকে বার বার স্টার্ট দেওয়ার চেষ্টা করতে দেখা যায়। ততক্ষণে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে যায়। এটাই বড় বিপদ ডেকে আনে।

অটো সিগন্যাল ব্যবস্থা চালু করে মানুষকে নির্দিষ্ট সিগন্যাল দেখামাত্র সঙ্গে সঙ্গে থেমে যাওয়ার মানসিকতায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এভাবে সঠিক মোটিভেশনে মানুষের মধ্যে অবৈধভাবে বেড়া ডিঙ্গানোর মানসিকতা এমনিতেই দূর হয়ে যাবে বলে আশা করা যায়।

লেখক: প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।

সূত্রঃ জাগোনিউজ২৪ডটকম


1 Trackbacks & Pingbacks

  1. exness com

Comments are closed.