ইসমাইল আলী: এক দশক ঝুলে থাকার পর ৭০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন কেনার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছে রেলওয়ে। সরবরাহকারীর ঋণে দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম কোম্পানি থেকে ইঞ্জিনগুলো কেনা হবে। এজন্য স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক (এসসিবি) ও জাপানের সুমিতোমো মিটসুই ব্যাংকিং করপোরেশন (এসএমবিসি) থেকে নেওয়া হচ্ছে কঠিন শর্তের ঋণ। যদিও এ ঋণের পরিমাণ ইঞ্জিনের দামের চেয়ে ১৭ শতাংশ বেশি, যা নিয়ে রয়েছে নানা ধরনের প্রশ্ন।
সূত্রমতে, ৭০টি ইঞ্জিন কেনায় ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর প্রায় ২৩ কোটি ৯৪ লাখ ৫৭ হাজার ডলার বা দুই হাজার ৩৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকার বাণিজ্যিক চুক্তি সই করে রেলওয়ে। চুক্তি অনুসারে ১৮ থেকে ৬০ মাসের মধ্যে ইঞ্জিনগুলো সরবরাহ করার কথা রয়েছে। তবে ঋণচুক্তি না হওয়ায় এ প্রক্রিয়া পিছিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে ইঞ্জিনগুলো কেনার জন্য ঋণ নেওয়া হচ্ছে প্রায় ২৮ কোটি দুই লাখ ৩২ হাজার ডলার বা দুই হাজার ৩৮১ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ চার কোটি আট লাখ পাঁচ হাজার ডলার বা ৩৪৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা বেশি ঋণ নেওয়া হচ্ছে। ইঞ্জিনের দামের চেয়ে ঋণের পরিমাণ ১৭ শতাংশ বেশি।
ইঞ্জিনের দামের চেয়ে ঋণ বেশি নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. শামছুজ্জামান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বলতে পারব না। রেলের ডিজি (মহাপরিচালক) কি সব বিষয় জানে? প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।’
প্রকল্প পরিচালক তো নতুন দায়িত্ব নিয়েছেন, আর মহাপরিচালক হওয়ার আগে তো আপনি অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আরএস) ছিলেন। তাই প্রকল্পটির সব বিষয়ই আপনার জানার কথা। এমন মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো উত্তর না দিয়েই তিনি মোবাইল ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
পরবর্তী সময়ে ৭০ ইঞ্জিন কেনা প্রকল্পের পরিচালক আহমেদ মাহবুব চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, মূলত দুটি কারণে ইঞ্জিনের মূল্যের চেয়ে বেশি ঋণ নেওয়া হচ্ছে। প্রথমত, ঋণ সরবরাহকারী ব্যাংক দুটি সুদ ছাড়াও মোটা অঙ্কের প্রিমিয়াম নিচ্ছে। এর পরিমাণ ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশ। দ্বিতীয়ত, সরকারি তহবিল থেকে এ প্রিমিয়াম পরিশোধের পরিবর্তে ঋণ গ্রহণের পক্ষে মতামত দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বিষয়টি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির (সিসিজিপি) অনুমোদন নিয়েই করা হয়েছে। তাই চার কোটি ডলার অতিরিক্ত ঋণ নিতে হচ্ছে। এ অর্থ মূলত ঋণের প্রিমিয়াম পরিশোধে ব্যবহার করা হবে।
তথ্যমতে, ইঞ্জিনগুলো কেনায় চারটি ভিন্ন প্যাকেজের আওতায় ঋণ দেওয়া হবে। এর মধ্যে কে-সিউরের আওতায় ঋণ দেওয়া হবে প্রায় ১১ কোটি ৯৫ লাখ ৮৯ হাজার ডলার। কে-এক্সিম গ্যারান্টিড ফ্যাসিলিটির আওতায় দেওয়া হবে প্রায় চার কোটি ২২ লাখ ২৫ হাজার ডলার ও কে-এক্সিম সরাসরি ফ্যাসিলিটির আওতায় প্রায় সাত কোটি ৮৪ লাখ ১৮ হাজার ডলার।
চুক্তি সইয়ের ৬০ মাসের মধ্যে এ তিন ধরনের ঋণ ছাড় করতে হবে। এর মধ্যে কে-সিউর ঋণের সুদহার হবে ছয় মাস মেয়াদি লন্ডন আন্তঃব্যাংক অফার রেটের (লাইবর) সঙ্গে এক দশমিক ৫৫ শতাংশ যোগ করে নির্ধারিত হার। এর সঙ্গে ইসিএ প্রিমিয়াম যুক্ত হবে ১৪ দশমিক ১৫ শতাংশ। আর কে-এক্সিমের দুই প্যাকেজের সুদহার হবে ছয় মাস মেয়াদি লাইবরের সঙ্গে দেড় শতাংশ যোগ করে নির্ধারিত হার। এক্ষেত্রে ইসিএ প্রিমিয়াম ১৪ দশমিক ৯০ শতাংশ।
আর চতুর্থ প্যাকেজের আওতায় চার কোটি ডলার ঋণ দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে সুদহার হবে ছয় মাস মেয়াদি লাইবরের সঙ্গে এক দশমিক ৬০ শতাংশ যোগ করে নির্ধারিত হার। আর ইসিএ প্রিমিয়াম সাড়ে তিন শতাংশ। এ প্যাকেজের ঋণ চুক্তি সইয়ের ৩৬ মাসের মধ্যে ছাড় করতে হবে।
ঋণের এ চার প্যাকেজেই ম্যানেজমেন্ট ফি (ঋণের) দেড় শতাংশ হারে। এছাড়া কমিটমেন্ট ফি দিতে হবে বছরে দশমিক ৫০ শতাংশ হারে। এক্ষেত্রে যে পরিমাণ ঋণ প্রতি বছর ছাড় হবে বাকিটার ওপর কমিটমেন্ট ফি পরিশোধ করতে হবে। এছাড়া প্রতি প্যাকেজের ঋণের জন্য আলাদাভাবে এজেন্ট ফি দিতে ২০ হাজার ডলার। আর চতুর্থ প্যাকেজের জন্য পৃথক ৪০ হাজার ডলার লিগ্যাল ফি দিতে হবে। সব মিলিয়ে সুদের হার সার্বিকভাবে ১০ শতাংশের কাছাকাছি পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ১৯ বছরে এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রেল যোগাযোগ উন্নয়নে বর্তমান সরকার খুবই আন্তরিক। তাই সরকার চাইলে নিজস্ব অর্থায়নেই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা যেত। এক্ষেত্রে কঠিন শর্তের ঋণ নেওয়ার কোনো দরকার ছিল না। কারণ উচ্চ সুদের পাশাপাশি এ ঋণের প্রিমিয়াম পরিশোধে আরও অতিরিক্ত চার কোটি ডলার ঋণ করতে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আগামীতে নতুন করে আর কোনো মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণ করা হবে। এছাড়া বিদ্যমান মিটারগেজ রেলপথগুলোও ডুয়েলগেজে রূপান্তর করা হচ্ছে। এছাড়া মিটারগেজ ইঞ্জিন কেনার কয়েকটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। ২০১১ সালে ইঞ্জিনের যে ঘাটতি ছিল তা কিছুটা কেটে গেছে। তাই ৭০টির পরিবর্তে ৩০টি ইঞ্জিন কিনলেই চলত। কিন্তু এসব বিষয় গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না।
প্রসঙ্গত, ২০১১ সালের ২৩ আগস্ট ৭০টি ইঞ্জিন কেনার প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। এর মধ্যে ৩০টি সম্পূর্ণ প্রস্তুতকৃত, ২৫টি অর্ধ উম্মুক্ত (হাফ নকডাউন) ও ১৫টি পূর্ণ উম্মুক্ত (ফুল নকডাউন) ইঞ্জিন কেনার প্রস্তাব রাখা হয়। অর্ধ ও পূর্ণ উম্মুক্ত ইঞ্জিনগুলো দেশে এনে রেলওয়ের নিজস্ব ওয়ার্কশপে সংযোজন করা হবে। এর মাধ্যমে রেলওয়ের কর্মীদের কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। সে সময় প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল এক হাজার ৯৪৫ কোটি ৮৯ লাখ টাকা।
সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ইঞ্জিনগুলো কেনার কথা ছিল। পরে সহজ শর্তের ঋণ বা সরবরাহকারীর ঋণে ইঞ্জিনগুলো কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে কঠিন শর্তের ঋণে ইঞ্জিনগুলো কেনা হচ্ছে।
এদিকে এক দশক ঝুলে থাকায় প্রকল্পটির ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৬৫৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ এরই মধ্যে ইঞ্জিনগুলো কেনায় ব্যয় বেড়ে গেছে ৭১৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা বা ৩৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ। তবে ঋণ চুক্তি না হওয়ায় প্রকল্পটি আরও বিলম্বিত হচ্ছে। এতে প্রকল্প ব্যয় আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সুত্র:শেয়ার বিজ, মার্চ ৯, ২০২০