শিরোনাম

রেল যেন নিধিরাম সর্দার

রেল যেন নিধিরাম সর্দার

শিপন হাবীব: দেশে প্রতিদিন আসন সংখ্যার বিপরীতে ১ লাখ ৪ হাজার ৮০ জন যাত্রী বিনা টিকিটে রেলভ্রমণ করছেন। অঙ্কের হিসাবে এ হার ৫৯ শতাংশ। সক্ষমতার অভাবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারছে না।১৫ বছর আগে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসানোর ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ায় টিকিটবিহীন যাত্রীদের সাজা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। টিকিট পরিদর্শকের ৭৩ শতাংশ পদ শূন্য থাকায় শতভাগ যাত্রীকে চেকের আওতায় আনা যাচ্ছে না।

৪৮৪টি স্টেশনের মধ্যে মাত্র ৭টিতে নিরাপত্তা বেষ্টনী আছে। বাকিগুলো উন্মুক্ত। ফলে এসব স্টেশন থেকে বিনা টিকিটের যাত্রীরা বাধাহীনভাবে বেরিয়ে যাচ্ছে।এছাড়া বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক ছুটির আগের দিন এবং ঈদসহ যে কোনো পার্বণে লম্বা ছুটিতে বিনা টিকিটে যাত্রীর সংখ্যা আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায়। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষের হাতে প্রয়োজনীয় ক্ষমতা না থাকায় অসহায়ভাবে দেখা ছাড়া তারা কিছুই করতে পারে না।

বিশেষ বিশেষ স্টেশনে ডিজিটাল স্ক্রিনিং মেশিন স্থাপনের জন্য এক যুগ ধরে রেলওয়েতে চিঠি চালাচালি চলছে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।সংশ্লিষ্টদের মতে, রেলওয়েতে ২৩ হাজার ১৭৮ পদ শূন্য। সারা দেশে ১২৩টি রেলস্টেশন বন্ধ হয়ে গেছে। এসব স্টেশন ও সংলগ্ন জমি বেহাত হওয়ার আশঙ্কা আছে। সড়ক পরিবহণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে পারছে না রেল।

সব মিলে রাষ্ট্রীয় সংস্থাটির আর্থিক ক্ষতি বছর বছর বেড়েই চলেছে। তাদের মতে, রেলের অবস্থা হয়েছে ‘ঢাল নেই তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার’-এর মতো।

এখান থেকে বেরিয়ে এসে রেলকে লাভজনক করতে হলে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। প্রয়োজনীয় লোকবল ও তাদের ক্ষমতা দিতে হবে বলে তারা মনে করেন। 

রেলে বর্তমানে ৩৬৬টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করছে। এর মধ্যে আন্তঃনগর ১০৪, মেইল লোকাল ও কমিউটার ২৬২টি। এসব ট্রেনের মধ্যে আন্তঃনগরে আসন (সিট) সংখ্যা ৭২ হাজার ৭০০ এবং মেইল, লোকাল ও কমিউটারে আসন আছে ১ লাখ ৪ হাজার ৮০০।রেলসংশ্লিষ্ট দপ্তর বলছে, প্রতিদিন আন্তঃনগর ট্রেনে আসন সংখ্যার বিপরীতে ৬৯ শতাংশ টিকিট বিক্রি হয়। ৩১ শতাংশ অবিক্রীত থাকে। আর লোকাল মেইল ও কমিউটার ট্রেনে আসন সংখ্যার মাত্র ১০ শতাংশ টিকিট বিক্রি হয়। বাকি ৯০ ভাগই বিক্রি হয় না।

অথচ কোনো ট্রেনের একটি আসনও খালি থাকে না। উলটো কামরার ভেতরে এবং কখনো কখনো ছাদে, ইঞ্জিনের উভয়পাশে ঝুলে ঝুলে গন্তব্যে পৌঁছান যাত্রীরা।

রেলওয়ের হিসাব অনুযায়ী দেখা যায়, প্রতিদিন আন্তঃনগরে আসনের বিপরীতে ১০ হাজার ৪৮০ জন এবং মেইল লোকাল ও কমিউটার মিলে গড়ে ৯৪ হাজার ৩২০ জন যাত্রী বিনা টিকিটে যাতায়াত করেন।সব মিলে আসনের বিপরীতে ট্রেনে দৈনিক টিকিট ছাড়া যাত্রীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৪ হাজার ৮০ জন। এর বাইরেও অনেক যাত্রী বিনা টিকিটে ভ্রমণ করে তাদের পরিসংখ্যান রেলওয়ের কাছে নেই।

এ প্রসঙ্গে রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, ট্রেন সরকারি পরিবহণ বলে বহুলোক বিনা টিকিটে যাতায়াত করেন। টিকিট ছাড়া ট্রেনে ভ্রমণ করা দণ্ডনীয় অপরাধ।

এটা বন্ধে লোকবলের অভাবে অভিযানও পরিচালনা করা যাচ্ছে না। অধিকাংশ স্টেশন উন্মুক্ত স্বীকার করে মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা স্টেশনগুলোর নিরাপত্তা বেষ্টনী নিশ্চিত করতে প্রকল্প নিচ্ছি। একই সঙ্গে জনবল বাড়াচ্ছি।

বিনা টিকিটে ভ্রমণ দণ্ডনীয় অপরাধ-এমনটা সাধারণ মানুষ আমলে নিচ্ছে না। সবাই টিকিট কেটে ট্রেনে ভ্রমণ করলে আয় দ্বিগুণ হতো। ব্যয় কমিয়ে আয় বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। আমরা এ বিষয়টি মাথায় রেখেই এগোচ্ছি। টিটিই ও স্টেশন মাস্টারদের ভাষ্য, প্রতিটি ট্রেনে স্বাভাবিক সময়েও যাত্রীতে ঠাসা থাকে। আর ঈদ কিংবা বিশেষ ছুটিতে কোনো ট্রেনেই তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না। তবুও টিকিট বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না।

ট্রেনযাত্রী ও সচেতন মানুষের প্রশ্ন, ট্রেন সিট খালি নিয়ে চলছে-এমন দৃশ্য কখনো দেখা যায়নি। বরং আসন সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি যাত্রী নিয়ে চলছে-এমনটা খোদ রেলওয়েসংশ্লিষ্টরাই বলছেন। 

জানা যায়, রেলওয়ে আইনে বিনা টিকিটে রেলভ্রমণ দণ্ডনীয় অপরাধ। একসময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বিনা টিকিটের যাত্রীদের সাজা দেওয়া হতো।কিন্তু প্রায় ১৫ বছর আগে ২০০৭ সালের ২৯ অক্টোবর সরকার রেলওয়ে কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা রহিত করে। এরপর থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা বন্ধ।আগে মাঝেমধ্যেই স্টেশনে ট্রেন পৌঁছার পর রেলপুলিশের সহায়তায় স্টেশন ব্লক করে বিনা টিকিটের যাত্রীদের পাকড়াও করা হতো। এরপর তাদের জরিমানা, কাউকে বড় ধরনের সাজাও দেওয়া হয়েছে।

চারদিকে খবর ছড়িয়ে পড়লে এর প্রভাব থাকত অনেকদিন। এতে বিনা টিকিটে যাত্রীর সংখ্যা হ্রাস পেত। কিন্তু এখন ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা না থাকায় এ ধরনের যাত্রী আটক করা সম্ভব হচ্ছে না।ফলে এদের দৌরাত্ম্য বাড়ছেই। পরিবহণ ও বাণিজ্যিক দপ্তরে প্রায় ৬৬ শতাংশ লোকবল স্বল্পতা নিয়ে গুটিকয়েক স্টেশনে নিয়মিত অভিযানও চালানো সম্ভব হচ্ছে না।এরপরও নানাভাবে প্রতিমাসে গড়ে সোয়া কোটি টাকা জরিমানা আদায় করা হয় বিনা টিকিটের যাত্রীর কাছ থেকে। এটা টিকিট পরিদর্শকরাই করে থাকেন।

তাদের সংকটও তীব্র। টিকিট পরিদর্শকের শূন্য পদ ৭৩ শতাংশ। একটি ট্রেনে ন্যূনতম ৮ জন পরিদর্শক থাকার কথা থাকলেও ২/৩ জন দায়িত্ব পালন করছেন। 

টিটিই (টিকিট পরিদর্শক) মো. জহির উদ্দিন যুগান্তরকে এ প্রসঙ্গে বলেন, আট কামরার (বগি) একটি ট্রেন স্টেশনে দাঁড়ালে যাত্রীরা দ্রুত নামতে শুরু করে। এ ধরনের ট্রেনে দরজা থাকে ৩২টি (প্রতি কামরায় ৪টি)। এই ৩২ দরজা দিয়ে যাত্রীরা নামতে থাকে।সেখানে টিটিই থাকেন মাত্র দুইজন। ওই ট্রেনের শতভাগ যাত্রীর কাছে টিকিট আছে কি না, তা দুজনের পক্ষে পরীক্ষা করা সম্ভব নয়। এছাড়া স্টেশনের নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকায় তাদের প্ল্যাটফরমের ভেতর আটকেও রাখা যায় না। রেলওয়ে ট্রাফিক বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বলেন, যদিও মাঝেমধ্যে ২/৩টি স্টেশনে অভিযান চালানো হয়, এতে চার থেকে পাঁচ শতাংশ বিনা টিকিটের যাত্রীর কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা যায়।

কিন্তু কাজটি আমাদের ঝুঁকি নিয়ে করতে হয়। কারণ স্থানীয় লোকজন রেলের কর্মীদের ওপর হামলা চালায়-এমন অনেক নজির আছে। টিকিটধারী যাত্রীদের বড় অংশের বক্তব্য, ট্রেনে টিকিট নেই এমন যাত্রীদের রাজত্ব চলে। তাদের অভিযোগ-নিরীহ যাত্রীদের কাছ থেকে টিটিইরা উৎকোচ নিয়ে ব্যবস্থা করে থাকেন।

তরুণ, প্রভাবশালীদের দাপটে টেকা দায় হয়ে পড়ে। অথচ জরিমানা নিশ্চিত করতে পারলে যাত্রীরা ভয় পেত, একই সঙ্গে সরকারের আয় বাড়ত।ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে ট্রেনের নিয়মিত যাত্রী বিল্লাল চৌধুরী জানান, যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে রেলের যে ন্যূনতম নজরও নেই, বৈধ যাত্রীদের দুঃসহ যন্ত্রণাই এর প্রমাণ। 

রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার সাহাদাত আলী যুগান্তরকে বলেন, ‘লোকবল স্বল্পতা অনেক। তাছাড়া ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাও নেই। তারপরও যেসব অভিযান পরিচালনা হয়, সেখানে বিনা টিকিটের কিছু যাত্রীর কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হয়।

স্টেশনগুলোয় শতভাগ নিরাপত্তা বেষ্টনী থাকলে এবং ট্রেনে বিনা টিকিট ব্যক্তি ওঠা ঠেকানো গেলে নিশ্চয় আয় বাড়ত। আমরা আসন সংখ্যার বিপরীতে সিটবিহীন টিকিটও প্রদান করি। বিনা টিকিট রোধে সাধারণ যাত্রীদের সহযোগিতাও প্রয়োজন।’

সূত্র:যুগান্তর, ২৮ আগস্ট ২০২২


About the Author

RailNewsBD
রেল নিউজ বিডি (Rail News BD) বাংলাদেশের রেলের উপর একটি তথ্য ও সংবাদ ভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল।

Comments are closed.