সুজিত সাহা:
নিয়ম লঙ্ঘন করে আন্তঃনগর ট্রেনে একের পর এক স্টপেজ (যাত্রাবিরতি) দিচ্ছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর মতামত না নিয়েই বাড়ানো হচ্ছে স্টপেজের সংখ্যা। এতে করে আন্তঃনগর ট্রেনগুলোও লোকাল ও মেইল ট্রেনের মতো ধীরগতির হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মূলত দ্বিতীয় শ্রেণীর ট্রেন সংকট এবং স্টেশন সংলগ্ন জেলা-উপজেলার রাজনৈতিক নেতাদের চাপে মন্ত্রণালয় এসব স্টপেজ অনুমোদন দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সম্প্রতি নরসিংদী স্টেশনে ঢাকা-নোয়াখালী রুটের উপকূল এক্সপ্রেস (উভয়পথে), ঢাকা থেকে সিলেটগামী রুটের উপবন এক্সপ্রেস ও সিলেট থেকে ঢাকাগামী কালনী এক্সপ্রেস ট্রেনের স্টপেজ দেয়া হয়। রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য মো. সিরাজুল ইসলাম মোল্লার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৪ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব এসএম শফিক স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এ যাত্রাবিরতির আদেশ দেয়া হয়, যা ২৭ সেপ্টেম্বর কার্যকর হয়েছে। এছাড়া কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম পৌরসভার মেয়র মো. মিজানুর রহমানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গুণবতী স্টেশনে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের প্রভাতী ও গোধূলী ট্রেনের যাত্রাবিরতি দেয়া হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, নরসিংদী স্টেশনে চারটি ট্রেনের যাত্রাবিরতির জন্য রেলের পরিবহন বিভাগের অনুমতি নেয়া হয়নি। আর গুণবতী স্টেশনে দুটি ট্রেনের স্টপেজ প্রদানে পরিবহন বিভাগ আপত্তি জানালেও তা গ্রাহ্য করেনি রেল ভবন।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ১৯ জুলাই রেল ভবনের উপপরিচালক মো. ময়েনুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে গুণবতী স্টেশনে স্টপেজ প্রদানে রেলওয়ের পরিবহন বিভাগের মতামত চাওয়া হয়। রেল ভবনের ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ২০ সেপ্টেম্বর পরিবহন বিভাগ থেকে ফিরতি চিঠিতে গুণবতী স্টেশনে দুটি আন্তঃনগর ট্রেনের স্টপেজের বিষয়ে আপত্তি জানানো হয়। রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালককে (অপারেশন) দেয়া ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ১৯৮৫ ও ১৯৮৬ সালে মহানগর প্রভাতী (৭০৪) ও মহানগর গোধূলী (৭০৩) ট্রেন চালু করার সময় পথিমধ্যে কোনো বিরতি ছিল না। বর্তমানে ৭০৩/৭৪২ নং ও ৭৪১/৭০৪ নং ট্রেনে প্রারম্ভিক ও গন্তব্য স্টেশন ছাড়াও সাতটি করে বিরতি রয়েছে। আগে ট্রেন দুটি ৫ ঘণ্টা ৫ মিনিটে গন্তব্যে পৌঁছালেও অধিক বিরতির কারণে এখন ৬ ঘণ্টা ১০ মিনিটে গন্তব্যে পৌঁছে। তিন দশকের বেশি সময় আগে ট্রেন দুটি মাত্র ৫ ঘণ্টায় চলাচল করলেও বর্তমানে রেল ব্যবস্থার উন্নয়ন সত্ত্বেও সময় বেড়েছে প্রায় ১ ঘণ্টারও বেশি। গুণবতী স্টেশনের দূরত্ব ফেনী থেকে মাত্র ১৩ দশমিক ৬৯ কিলোমিটার ও লাকসাম থেকে ২৬ দশমিক ২৫ কিলোমিটার। ফেনী ও লাকসাম স্টেশনে ট্রেন দুটির বিরতি থাকায় গুণবতী স্টেশনে বিরতি প্রদান করলে রেলের সেবার মানে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
কিন্তু পরিবহন বিভাগের এমন আপত্তি সত্ত্বেও রেল ভবন ১ অক্টোবর এক আদেশে গুণবতী স্টেশনে দুটি ট্রেনের বিরতি প্রদানের বিষয়টি অনুমোদন করে। রেল ভবনের উপপরিচালক (ট্রাফিক ট্রান্সপোর্টেশন) খালিদুন নেছা স্বাক্ষরিত চিঠিতে ৬ অক্টোবর থেকে গুণবতী স্টেশনে বিরতি প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। লাকসামের মতো রেলওয়ে জংশনে আন্তঃনগর ট্রেনগুলোয় ১০ থেকে ১৫টি টিকেট বরাদ্দ থাকলেও নতুন প্রবর্তিত স্টপেজে ১০টি শোভন চেয়ার ও ১০টি এসি চেয়ার টিকিট সংরক্ষণ করা হয়েছে। যদিও এভাবে যত্রতত্র স্টপেজ দেয়াটা রেলওয়ের আন্তঃনগর ম্যানুয়ালের পরিপন্থী।
উল্লেখ্য, আন্তঃনগর ম্যানুয়ালে (নং-১/৩১) বলা আছে, ‘আন্তঃনগর ট্রেন স্বল্প সময়ে দূরে গন্তব্যে স্বচ্ছন্দ ভ্রমণ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে প্রবর্তিত একটি দ্রুতগতিসম্পন্ন বিশেষ শ্রেণীর ট্রেন। স্বাভাবিক কারণেই এ ট্রেনগুলোর বিরতি সংখ্যা যথাসম্ভব সীমিত থাকবে এবং স্পষ্টতই গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন বা জংশন ছাড়া অন্য কোনো স্টেশনে এই শ্রেণীর ট্রেনের বিরতি থাকবে না।’
আন্তঃনগর ট্রেনগুলোকে ‘ক’, ‘খ’ ও ‘গ’— এ তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে রেলওয়ে ম্যানুয়ালে। এর মধ্যে ‘ক’ শ্রেণীর আন্তঃনগর ট্রেনকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদানের নির্দেশনা থাকলেও অনাকাঙ্ক্ষিত বিরতির ক্ষেত্রে ‘ক’ শ্রেণীর ট্রেনকেই সবচেয়ে বেশি টার্গেট করছে স্টেশন সংলগ্ন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, যাত্রীদের অধিক সেবা প্রদানের জন্য আমরা অবশ্যই আন্তঃনগর ট্রেনকে দ্রুতগতিসম্পন্ন রাখতে চাই। তবে স্থানীয় জনগণের দাবির মুখে অনেক সময় আন্তঃনগর ট্রেনগুলোয় বিরতি প্রদান করতে হয়। নিয়ম না থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন-সংগ্রামের কারণে জনগণের সুবিধার স্বার্থেই বিরতি দেয়া হচ্ছে। এতে রেলপথ মন্ত্রণালয় কিংবা রেলওয়ের নিজস্ব কোনো স্বার্থ নেই।
এদিকে নরসিংদী স্টেশনে গুরুত্বপূর্ণ ‘ক’ শ্রেণীর চারটি ট্রেনের নতুন করে যাত্রাবিরতি প্রদানের অফিস অর্ডারের সময় পূর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষ একটি অনাপত্তির চিঠি দেয়। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ১৯৮৬ সালের ১৭ মার্চ ঢাকা-নোয়াখালী-ঢাকা রুটে উপকূল এক্সপ্রেস (৭১১ ও ৭১২ নং ট্রেন) চালুর সময় স্টপেজ রাখা হয়েছিল সাতটি। বর্তমানে এ ট্রেনের স্টপেজ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২টিতে। নরসিংদীতে নতুন স্টপেজ দেয়ার ফলে ট্রেনটির ক্ষেত্রে আন্তঃনগর ট্রেনের মান সম্পূর্ণ ভেঙে পড়বে। এছাড়াও ১৯৮৮ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকা-সিলেট-ঢাকা রুটে উপবন এক্সপ্রেস (৭৩৯ নং ট্রেন) চালুর সময় স্টপেজ ছিল মাত্র ছয়টি। বর্তমানে স্টপেজ বেড়ে হয়েছে নয়টি। অন্যদিকে ২০১২ সালের ১৫ মে সিলেট-ঢাকা-সিলেট রুটের কালনী এক্সপ্রেস (৭৭৩ ও ৭৭৪ নং ট্রেন) চালুর সময় পাঁচটি, বর্তমানে স্টপেজের সংখ্যা আটটি। নরসিংদীতে নতুন যাত্রাবিরতি দেয়ার ফলে এসব ট্রেনের বিরতির সংখ্যা বেড়ে ট্রেনগুলোর গন্তব্যে পৌঁছাতে ১৫ মিনিট পর্যন্ত সময় বেড়ে যাবে বলে জানিয়েছেন রেল কর্মকর্তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন রুটে ৩৬টি স্টপেজ দেয়া হয়। এর মধ্যে শুধু ২০১৩ সালেই দেয়া হয় ১৩টি। গত পাঁচ বছরে রাজনৈতিক বিবেচনায় দেয়া স্টপেজের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৭টি স্টপেজ দেয়া হয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে। এছাড়া ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে ছয়টি, ঢাকা-সিলেট রুটে ছয়টি, চট্টগ্রাম-সিলেট রুটে চারটি, ঢাকা-নোয়াখালী রুটে দুটি ও চট্টগ্রাম-চাঁদপুর রুটে একটি ট্রেন। এরপর চলতি বছরও ১০টির বেশি ট্রেনের যাত্রাবিরতি দেয়া হয়েছে।
রেলসংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনাকাঙ্ক্ষিত স্টপেজ দেয়ায় আন্তঃনগর ট্রেনের প্রতি যাত্রীদের আগ্রহ কমে যাবে, যা রেলের আয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এছাড়া গন্তব্যে পৌঁছানোর সময় বৃদ্ধির পাশাপাশি রেলের পরিবহন খরচও বেড়ে যাবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, রেলওয়ের বিভিন্ন স্টেশনে যাত্রাবিরতির জন্য লোকাল, মেইল, এক্সপ্রেস ও কমিউটার ট্রেন রয়েছে। আন্তঃনগর ট্রেনগুলোকে সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা প্রদানের নিয়ম রয়েছে রেলওয়ে আইনে। কিন্তু স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের চাপে রেলওয়ে নিরুপায়। পরিবহন বিভাগের মতামত না নিয়েই রেলপথ মন্ত্রণালয় ও রেল ভবন নিয়ম লঙ্ঘন করে যত্রতত্র স্টপেজ দিচ্ছে। রেলকে লোকসানি খাত থেকে বেরিয়ে আনতে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চালু থাকলেও বিরতি প্রদানের মাধ্যমে পরিবহন ব্যয় বাড়ানো হলে রেলওয়ের সেবার মান কমে যাবে বলে জানান তিনি।
সুত্র:বণিক বার্তা, অক্টোবর ০৮, ২০১৮