শিরোনাম

রেলে দুর্নীতির পুরস্কার পদোন্নতি!

রেলে দুর্নীতির পুরস্কার পদোন্নতি!

ইসমাইল আলী  নজরুল ইসলাম:‘জ্ঞাত আয়ের বাইরে’ সম্পদ উপার্জন ও বিদেশে পাচারের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একাধিক মামলার আসামি। গ্রেপ্তার এড়াতে নিয়েছেন হাইকোর্টের আগাম জামিন। এরপরও চাকরিতে বহাল তবিয়তেই রয়েছেন রেলওয়ের কর্মকর্তা মো. রমজান আলী। সম্প্রতি তাকে সরকারি রেল পরিদর্শক পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যদিও ২৪ জানুয়ারি তার বিরুদ্ধে একটি মামলায় চার্জশিট অনুমোদন দিয়েছে দুদক।

সূত্রমতে, মো. রমজান আলী রেলওয়ে ক্যাডারের চতুর্থ গ্রেডের কর্মকর্তা। তবে গত ৩০ ডিসেম্বর তাকে তৃতীয় গ্রেডের পদমর্যাদায় চলতি দায়িত্বে সরকারি রেল পরিদর্শক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। আর ‘জ্ঞাত আয়ের বাইরে’ সম্পদ অর্জনের মামলায় মো. রমজান আলীর বিরুদ্ধে তদন্তকারী কর্মকর্তার দাখিল করা সাক্ষ্য-স্মারক ও অন্যান্য রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে দুদক আইন, ২০০৪-এর ৩২ ধারা এবং দুদক বিধিমালা, ২০০৭-এর বিধি ১৫-এর উপবিধি ১-এর ক্ষমতাবলে চার্জশিট অনুমোদন দিয়েছে দুদক।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘সরকারি রেল পরিদর্শক’ হলো রেলওয়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ। নতুন রেললাইন নির্মাণ, ইঞ্জিন-কোচ ইত্যাদি কেনার পর রেল পরিদর্শকের অনুমোদন ব্যতীত সেগুলো ব্যবহার করা সম্ভব নয়। তাই এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেয়ায় রেলওয়ের স্বার্থ ক্ষুণœ হতে পারে। এছাড়া দুর্নীতি মামলার আসামিকে এমন গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ নিয়ে দুদকের কর্মকর্তাও বিস্মিত।

তথ্যমতে, দুদকের উপপরিচালক মো. আবুবকর সিদ্দিক ২০২০ সালের ১৬ আগস্ট কমিশনের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয় (১)-এ রমজান আলী ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুটি মামলা দায়ের করেন। পরে দুদকের উপপরিচালক মো. আলী আকবর মামলা দুটির মধ্যে একটি মামলার (নম্বর-৭) তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োজিত হন। তদন্ত শেষে তিনি দুদক কমিশনে সেটি দাখিল করেন। কমিশন চার্জশিট দাখিলের অনুমোদন দিল।

জানতে চাইলে দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, দুদকের মামলার আসামিকে রেলওয়ে কীভাবে পদোন্নতি দিয়েছে, সেটা তারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাকে গুরুত্বপূর্ণ পদায়ন করা অবশ্যই বিস্ময়কর।

সূত্রমতে, রমজান আলীর বিরুদ্ধে মামলায় দুই কোটি ৪৩ লাখ ৮০ হাজার ২৮৬ টাকার ‘জ্ঞাত আয়বহির্ভূত’ সম্পদ অর্জন এবং অর্থ পাচারের অভিযোগ আনা হয়। আর তার স্ত্রী দিলরুবা পারভীন ইলোরার বিরুদ্ধে ১ কোটি ৮৫ লাখ ৮ হাজার ৬৫৬ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়।

মো. রমজান আলী রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী। তিনি বাংলাদেশ রেলওয়ের খুলনা-মোংলা বন্দর রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালকও ছিলেন। এছাড়া আখাউড়া-লাকসাম ডাবল লাইন ডুয়েল গেজ প্রকল্পেরও পরিচালক ছিলেন। তবে দুদকের মামলার পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে তাকে প্রকল্প পরিচালকের পদ থেকে প্রত্যাহার করে যুগ্ম মহাপরিচালক (প্রকৌশল) পদে (চলতি দায়িত্ব) পদায়ন করা হয়। সে পদটি ছিল ৩য় গ্রেডভুক্ত। রমজান আলীর বাড়ি পাবনা জেলার সাঁথিয়া উপজেলার বেড়ার ভিটাপাড়া গ্রামে। বর্তমানে তারা রাজধানী ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বসবাস করেন।

মামলার এজাহারে বলা হয়, রমজান আলী চাকরি করার সময়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়ম, দুর্নীতির মাধ্যমে তার নিজের ও স্ত্রীর নামে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন। এর মধ্যে অর্ধেকের কিছু বেশি টাকার সম্পদ রেখেছেন গৃহিণী স্ত্রী আগা দিলরুবা পারভীন ইলোরার নামে। রমজান আলীর নামে রয়েছে দুই কোটি ৪৩ লাখ ৮০ হাজার ২৮৬ টাকার সম্পদ। তাছাড়া তার গৃহিণী স্ত্রী আগা দিলরুবা পারভীন ইলোরার নামে রয়েছে দুই কোটি ৪৭ লাখ ৯০ হাজার ৬৫৬ টাকার সম্পদ। এর মধ্যে ১ কোটি ৮৫ লাখ ৮ হাজার ১৮০ টাকার সম্পদ আয়ের উৎস বহির্ভূত।

অনুসন্ধানে আরও দেখা গেছে, রমজান আলী বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এইচ ব্লকের ৬ নম্বর রোডের ৪৯৭ নম্বর প্লটে তিন কাঠা জমিতে আট তলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন। এই বাড়ির প্রতি তলার ফ্লোরের আয়তন দেড় হাজার বর্গফুট। বাড়িটির বর্তমান মূল্য এক কোটি ৮০ লাখ টাকা। এছাড়া রমজান প্রাইভেট কার (নম্বর-গ-২৯-৩৪৮২) কেনার পাশাপাশি নগদ অর্থ ও অন্যান্যসহ মোট দুই কোটি ৭০ লাখ ৪৪ হাজার ৮৩৬ টাকার সম্পদ অবৈধভাবে অর্জন করেছেন। অন্যদিকে তার ৬৮ লাখ ২৭ হাজার ৮৯২ টাকা আয়ের বৈধ উৎসের মধ্যে রয়েছেÑবেতন-ভাতা, কৃষিকাজ, জমি বিক্রিসহ বিভিন্ন খাত। এই অর্থ থেকে তিনি পারিবারিক ভরণ-পোষণ খাতে ব্যয় করেছেন ৪১ লাখ ৬৩ হাজার ৮৭২ টাকা। পারিবারিক ব্যয় বাদে তার নিট আয় থাকে ২৬ লাখ ৬৪ হাজার ৫৫০ টাকা। বাকি দুই কোটি ৪৩ লাখ ৮০ হাজার ২৮৬ টাকার সম্পদ তিনি অবৈধভাবে অর্জন করেছেন।

এই সম্পদ নিজের ভোগদখলে রেখে রমজান আলী শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। দুদক তার বিরুদ্ধে দুদক আইন-২০০৪ এর ২৭(১) ধারা ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ এর ৪ (২) ও ৪ (৩) ধারায় মামলা হয়েছে। একই ধারায় রমজানের স্ত্রীর বিরুদ্ধেও মামলা করা হয়। রমজান আলীর নামে পাবনার সাঁথিয়া ও সরিষাফরিদ মৌজায় প্রচুর জমি রয়েছে। তিনি ১২ লাখ টাকা দামের প্রাইভেট কার কিনেছেন। নামে-বেনামে ইসলামী, ডাচ্-বাংলা, ট্রাস্ট ও ব্র্যাক ব্যাংকে নগদ অর্থ জমা রয়েছে। এ ছাড়া স্বর্ণালঙ্কার, দামি আসবাবপত্র ও বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীও রয়েছে তার নামে।

এদিকে দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর মুখ্য হাকিম কে. এম ইমরুল কায়েশ রমজানের বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এইচ ব্লকের ৬ নম্বর রোডের ৪৯৭ নম্বর প্লটের আট তলা বাড়িটি ক্রোকের আদেশ দেন।

দুদকের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রমজান আলী কৌশলে স্ত্রী আগা দিলরুবা পারভীন ইলোরার নামেও বিভিন্ন দামি সম্পদ রেখেছেন। তার নামে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক প্রকল্পে ৩৩০৭ নম্বর প্লটে তিন কাঠা জমি কেনা হয়েছে, যার বর্তমান বাজারমূল্য ১৪ লাখ ৬৭ হাজার ৩০০ টাকা। বসুন্ধরা আবাসিক প্রকল্পে ১০৮০ নম্বর প্লটে আরও তিন কাঠা জমি কেনা আছে ইলোরার নামে, যার বর্তমান বাজার মূল্য ২৬ লাখ টাকা। ইলোরার নামে জামালপুরের সিংজানি মৌজায় ৭৩ লাখ ১৩ হাজার ৭০৭ টাকা মূল্যের চার শতাংশ জমি এবং জামালপুরের সিংহজানি মৌজায় আরও ছয় শতাংশ জমি কিনে পাঁচ তলা আবাসিক ভবন নির্মাণ করেছেন রমজান। এর বর্তমান বাজার মূল্য ৮২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। পাবনার সরিষাফরিদ মৌজায় ২১ শতাংশ জমি রয়েছে রমজানের স্ত্রীর নামে, যার বর্তমান বাজার মূল্য পাঁচ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

এ বিষয়ে জানতে মো. রমজান আলীকে একাধিকবার মোবাইল ফোনে কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। এ ছাড়া এসএমএস দেয়া হলেও তিনি উত্তর দেননি।

উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ১৬ আগস্ট দুদক মামলা দায়েরের পর তারা উচ্চ আদালতে গেলে ২০ আগস্ট হাইকোর্ট তাদের ছয় সপ্তাহের আগাম জামিন দেন। ওই জামিন স্থগিত চেয়ে দুদক আবেদন করলে ২৭ আগস্ট আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত আবেদনটি শুনানির জন্য পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন। শুনানি শেষে আপিল বিভাগ দুদকের আবেদন খারিজ করে দেন। বর্তমানে তিনি জামিনে আছেন।


About the Author

RailNewsBD
রেল নিউজ বিডি (Rail News BD) বাংলাদেশের রেলের উপর একটি তথ্য ও সংবাদ ভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল।

Comments are closed.