পিনাকি দাসগুপ্ত :
দিন দিন বাড়ছে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর ঘটনা। আর এসব দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ সিংহভাগই অসর্তকতা আর মোবাইল ফোনে কথা বলা। রেল কর্তৃপক্ষ ও রেলপুলিশ এ ধরনের ভয়াবহ মৃত্যুর ঘটনা কমাতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিলেও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। তবে ব্যক্তিগত সতর্কতার পাশাপাশি সামাজিক ও সরকারিভাবে জনসচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। সর্বশেষ গতকাল বুধবার দুপুরে কুড়িল বিশ্বরোডে রেললাইন ধরে হাঁটার সময় ট্রেনের ধাক্কায় প্রাণ হারিয়েছেন ষাটোর্ধ্ব ফিরোজা বেগম। শেষ মুহূর্তে লাফিয়ে পড়ায় বেঁচে গেছেন তার মেয়ে নাজমা বেগম (৩৫)। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে রেললাইন ধরে খিলক্ষেতের দিকে হাঁটছিলেন নাজমা। আর ফিরোজা বেগম হাঁটছিলেন তার পেছনে পেছনে। ওই সময় কমলাপুর থেকে ছেড়ে আসা একটি ট্রেন তাদের পেছনে চলে আসে। শেষ সময়ে ট্রেন আসার বিষয়টি বুঝতে পেরে নাজমা সরে যেতে পারলেও তার মা ট্রেনের ধাক্কায় মাথায় আঘাত পেয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান।
রেলসূত্র জানায়, গত এক বছরে রেলওয়ের পুর্বাঞ্চল বিভাগে রেললাইনে কাটা পড়ে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৭শ জন। এরমধ্যে গত ৩ মাসে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা-জামালপুর রুটে ট্রেনে পড়ে মারা গেছে ৩৩ জন। যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে আইন- শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ছাত্র থেকে শুরু করে তরুণ, যুবা, বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাও রয়েছেন।
ঢাকা জিআরপি থানার ওসি ইয়াছিন ফারুক মজুমদার বলেন, রেললাইন দিয়ে হাঁটা আইনত নিষিদ্ধ এবং বিপদজ্জনক। তারপরও মানুষ প্রচলিত আইন অমান্য করে অসচেতনভাবে হাঁটতে গিয়ে চলন্ত ট্রেনে কাটা পড়ছে। প্রতিনিয়ত ট্রেনে কাটা পড়ে নিহতের ঘটনাকে দুঃখজনক উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ অবস্থা থেকে নিষ্কৃতির জন্য জনগণকে সচেতন হতে হবে। সচেতনতার বাইরে এর কোনো সমাধান নেই।
তিনি বলেন, ট্রেনে কাটার অধিকাংশ ঘটনাই ঘটছে মোবাইল ফোনে কথা বলার কারণে। এ নিয়ে রেলপুলিশ মানুষকে সচেতন করার জন্য বিরামহীনভাবে প্রচারণা চালিয়েছে যাচ্ছে। কিন্তু তার পরও ঠেকানো যাচ্ছে না।
ইয়াছিন ফারুক মজুমদার বলেন, ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ, রেললাইন ধরে হাঁটা, রেললাইন ধরে হাঁটার সময় মোবাইল ফোনে কথা বলাসহ বিভিন্ন বিষয় সতর্কতামূলক লিফলেট, ব্যানার প্রতিনিয়ত বিলি করা হচ্ছে। পাশাপাশি স্কুল, কলেজ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়েও বৈঠক করা হচ্ছে। এ কর্মকর্তা আরো বলেন, প্রায়াই মিডিয়াতে প্রচারিত হচ্ছে দুর্ঘটনার খবর, প্রচার-প্রচারণা। তারপরও অনেকের বোধদয় হয় না। অপর এক প্রশ্নের জবাবে রেলপুলিশের এ কর্মকর্তা বলেন, রেলপুলিশের জনবল অনেক কম। ইচ্ছে করলেও রেলপথে অবৈধ জনচলাচল বন্ধ করা সম্ভব না। এ জন্য প্রয়োজন সচেতনতা। আর সচেনতা তৈরি না হলে দুর্ঘটনা কোনো ভাবেই কমানো সম্ভব না।
রেল সূত্র জানায়, সারাদেশের রেলপথের দুই পাশে ১০ ফুট করে ২০ ফুট এলাকায় সবসময় ১৪৪ ধারা জারি থাকে। বাংলাদেশ রেলওয়ে আইনানুযায়ী ওই সীমানার ভেতর কাউকে পাওয়া গেলে তাকে আইনের ১০১ ধারায় গ্রেফতার করা যায়। এমনকি এই সীমানার ভেতরে গবাদিপশু চরালে আটক করে তা বিক্রি করে সেই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা দেওয়ার বিধানও রয়েছে। বাস্তবতা হলো: আইনের ধারা-বিধান বই-নথিতেই লিপিবদ্ধ থাকে; সেগুলোর প্রয়োগ হয় না। প্রয়োগ করতে গেলে রেলওয়ে পুলিশকে বরং মুখোমুখি হতে হয় নানা বিব্রতকর পরিস্থিতি ও উটকো ঝামেলায়। সারাদেশে মোট রেলপথ ২ হাজার ৮৭৮ কিলোমিটার। আর অবৈধ রেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা ১ হাজার ৩০০টি। এই অবৈধ ক্রসিং দিয়ে পারাপার, রেললাইনের উপর দিয়ে অবাধে চলাচলসহ নানা কারণে প্রতি বছর ট্রেনে কাটা পড়ে গড়ে প্রাণ হারাচ্ছে দুই হাজার মানুষ। আর এই লাশ দাফন বা লাশ দাহ করার জন্য রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ প্রশাসনকে বছরে গুণতে হচ্ছে দুই কোটি টাকা।
সুত্র:ইত্তেফাক, ১৭ মে, ২০১৮