ইসমাইল আলী: যাত্রী পরিবহন সক্ষমতা বাড়াতে ২০০ ব্রডগেজ কোচ কিনবে রেলওয়ে। ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (ইআইবি) ঋণে কোচগুলো কেনার কথা রয়েছে। এগুলোর মূল্য ধরা হয়েছে এক হাজার ৩১০ কোটি ২৬ লাখ টাকা। যদিও সম্ভাব্যতা যাচাইকালে এ ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯৪৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। এ হিসাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রায় ৩৯ শতাংশ বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে।
এদিকে ভ্যাট-শুল্ক ছাড়া প্রতিটি কোচের দাম পড়ছে ছয় কোটি ৫৯ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। রেলের সম্প্রতি কেনার কোচের চেয়ে এ ব্যয় ৪৩ শতাংশ বেশি। যদিও কোচগুলোর দাম নিয়ে গত বছর আপত্তি তুলেছিল পরিকল্পনা কমিশন। তবে এর কোনো প্রভাব দেখা যায়নি। উল্টো কোচগুলো কেনায় ব্যয় আরও বেড়ে যাচ্ছে।
তথ্যমতে, ২০০ ব্রডগেজ কোচ কেনায় প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৭৩৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে এক হাজার ৩৫৫ কোটি ৯৮ লাখ টাকা ঋণ দেবে ইআইবি। এর মধ্যে শুধু কোচের দাম ধরা হয়েছে এক হাজার ৩১০ কোটি ২৬ লাখ টাকা। আর ভ্যাট-শুল্কসহ অন্যান্য খাতে ৩৭৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকা সরকারি তহবিল থেকে সরবরাহ করা হবে।
প্রকল্পটির ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০ কোচের মধ্যে রয়েছে এক সেট (চারটি) সেলুন, তিনটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ইন্সপেকশন কার, চারটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অ্যাম্বুলেন্স সিøপার কার, ২৫টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সিøপার কার, ৪২টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চেয়ার কার, ৮০টি শোভন চেয়ার কার, ১৬টি ডাইনিং ও নামাজের ব্যবস্থা সংবলিত শোভন চেয়ার কার ও ২৬টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত লাগেজ ভ্যান সংবলিত পাওয়ার কার।
প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাইকালে ধরনভেদে প্রতিটি কোচের একক দর ধরা হয়েছিল যথাক্রমে ২৮ কোটি ২৩ লাখ টাকা, সাত কোটি তিন লাখ, আট কোটি ১৬ লাখ, পাঁচ কোটি ১১ লাখ, চার কোটি ৭১ লাখ, চার কোটি ১৮ লাখ, চার কোটি ১১ লাখ ও পাঁচ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। তবে প্রকল্পটি চূড়ান্ত করার সময় ধরনভেদে প্রতিটি কোচের একক দর বেড়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৫৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকা, ১০ কোটি ১৭ লাখ, সাত কোটি ৫১ লাখ, ছয় কোটি ৩৬ লাখ, ছয় কোটি ২৩ লাখ, পাঁচ কেটি ৭৮ লাখ, পাঁচ কোটি ৭৮ লাখ ও আট কোটি ৪৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রত্যেক ধরনের কোচের দামই বাড়তি ধরা হয়েছে। সব মিলিয়ে কোচগুলো কেনায় ৩৬৫ কোটি ৪২ লাখ টাকা বা ৩৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ দাম বেশি দেখানো হয়েছে।
ডিপিপিতে আরও দেখা যায়, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ঋণে রেলওয়ে ২০০টি মিটারগেজ ও ৫০টি ব্রডগেজ কোচ কিনেছে ২০১৭ সালে। এর মধ্যে প্রতিটি ব্রডগেজ কোচের দাম পড়েছিল ভ্যাট-শুল্ক ছাড়া গড়ে চার কোটি ৬০ লাখ ৭১ হাজার টাকা। আর প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় ব্রডগেজ যাত্রীবাহী কোচের ইউনিটপ্রতি দাম ধরা হয়েছে গড়ে ছয় কোটি ৫৯ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। এ হিসাবে গড়ে প্রতি কোচের দাম বেশি ধরা হয়েছে এক কোটি ৯৮ লাখ ৭৭ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. শামছুজ্জামান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কোচগুলো কিনতে আরও কয়েক বছর লাগবে। এতে ব্যয় আরও বাড়তে পারে। যদিও দরপত্র চূড়ান্ত হলে জানা যাবে কোচগুলোর দাম কত পড়বে। তবে কোচগুলোয় বায়ো-টয়লেটসহ আধুনিক বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা সংযুক্ত করা হচ্ছে। তাই দাম কিছুটা বেশি পড়াই স্বাভাবিক।
যদিও রেল কোচে বায়ো-টয়লেট সংযোজনের বিষয়টি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অবান্তর বলে মনে করেন ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ (ডব্লিউবিবি) ট্রাস্টের প্রকল্প কর্মকর্তা ও রেলবিষয়ক গবেষক মো. আতিকুর রহমান। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, গত দুই বছরে বায়ো-টয়লেটযুক্ত যেসব কোচ কেনা হয়েছে সেগুলোর কোনো ধরনের ব্যবস্থাপনা নেই। কোচগুলোর বর্জ্য কোথায় ফেলা হবে তা নিশ্চিত নয়। আবার টয়লেটে অনেকে টিস্যু পেপারসহ বিভিন্ন ধরনের আবর্জনা ফেলছে। এতে বায়ো-টয়লেটগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, পাশের দেশ ভারত যাত্রীবাহী ট্রেনে বায়ো-টয়লেট যুক্ত করলেও সেগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করতে পারেনি। এজন্য সেগুলো বাদ দেওয়া হবে কি না, তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে দেশটি। তাই আমাদের দেশে বায়ো-টয়লেট সংযোজন একটি বিলাসী পরিকল্পনা। আর এ সুযোগে প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে দেওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়।
উল্লেখ্য, কোচগুলো কেনার প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য গত বছর পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায় রেলওয়ে। সে সময় ভ্যাট-শুল্ক ছাড়া প্রতিটি কোচের দাম ধরা হয়েছিল ছয় কোটি ৩৫ লাখ ১৫ হাজার টাকা। উচ্চ ব্যয় নিয়ে সে সময় আপত্তি তুলেছিল পরিকল্পনা কমিশন। তবে ব্যয় না কমে উল্টো বেড়ে গেছে।
সূত্র জানায়, ইআইবির ঋণে ২০০ কোচ কেনার ক্ষেত্রে ভারতের ঋণে কেনা কোচের দামকে ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়েছে। ওই কোচগুলোর দাম ছিল ছয় কোটি ৩৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা। এর সঙ্গে বছরভিত্তিক তিন শতাংশ মূল্যবৃদ্ধিজনিত ব্যয় যোগ করা হয়েছে। এতে ভ্যাট-শুল্ক ছাড়া প্রতিটি কোচের দাম পড়ছে ছয় কোটি ৫৯ লাখ ৪৮ হাজার টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারতের ঋণে কোচ কেনার ক্ষেত্রে সীমিত দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। তাতে ভারতীয় কোম্পানি ছাড়া অন্য কেউ অংশ নিতে পারেনি। এতে কোচের দাম কিছুটা বেশি পড়েছে। আর ইআইবির ঋণে উš§ুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হবে। এডিবির ঋণে কোচ কেনার ক্ষেত্রেও উš§ুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। এতে প্রাক্কলিত দরের চেয়ে অনেক কমে কোচ কিনেছিল রেলওয়ে। তাই এবারও দাম কম পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
উল্লেখ্য, বর্তমানে রেলওয়ের ৪২৮টি ব্রডগেজ যাত্রীবাহী কোচ রয়েছে। এর মধ্যে ১৮৭টির অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে গেছে। মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী আগামী ৩০-৩৫ বছরের মধ্যে রেলওয়ের সব ট্র্যাক ব্রডগেজে রূপান্তর করা হবে। এছাড়া যমুনা নদীর ওপর রেলসেতু নির্মাণ করা হয়েছে ও পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প সম্পন্ন হলে সারা দেশে ব্রডগেজ ট্রেনের সংখ্যা বেড়ে যাবে। এজন্য পুরোনো কোচগুলো প্রতিস্থাপনসহ ২-৪ বছরের মধ্যে নতুন ৪০০ কোচ দরকার হবে। তাই নতুন কোচগুলো কেনা জরুরি বলে ডিপিপি উল্লেখ করা হয়েছে।
সূত্র:শেয়ার বিজ, নভেম্বর ১৪, ২০২০