শিরোনাম

জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডাবল লাইন নির্মাণে অত্যধিক ব্যয়ের উদ্যোগ

জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডাবল লাইন নির্মাণে অত্যধিক ব্যয়ের উদ্যোগ

ইসমাইল আলী : জয়দেবপুর থেকে ঈশ্বরদী পর্যন্ত ডুয়েলগেজ রেলপথটি ডাবল লাইনে উন্নীত করা হবে। এজন্য ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর একটি প্রকল্প অনুমোদন করে সরকার। চীনের অর্থায়নে জিটুজি ভিত্তিতে রেলপথটি নির্মাণ করবে চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। দরপত্র ছাড়াই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। যদিও প্রকল্পটির ব্যয় রেলওয়ের একই ধরনের চলমান অন্যান্য প্রকল্পের চেয়ে অনেক বেশি।

সূত্রমতে, জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডাবল লাইন প্রকল্পটির ব্যয় নিয়ে শুরু থেকে আপত্তি ছিল সংশ্লিষ্টদের। সম্প্রতি প্রকল্পটির ব্যয় খতিয়ে দেখতে কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে একটি কমিটি গঠন করে রেলওয়ে। ওই কমিটি প্রায় ২১৭ কোটি টাকা বেশি ব্যয় চিহ্নিত করেছে। দোহাজারী-কক্সবাজার ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের সঙ্গে তুলনাপূর্বক অতিরিক্ত ব্যয় চিহ্নিত করা হয়েছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের সাম্প্রতিক এক বিশ্লেষণেও জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডাবল লাইন নির্মাণে অত্যধিক ব্যয়ের বিষয়টি উঠে আসে। এতে দেখা যায়, রেলওয়ের চলমান ৫টি ডুয়েলগেজ রেলপথ প্রকল্পের মধ্যে জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডাবল লাইন নির্মাণে ব্যয় সবচেয়ে বেশি। জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডাবল লাইন ডুয়েলগেজ রেলপথের দৈর্ঘ্য ১৯৮ দশমিক ২৯ কিলোমিটার। এ রেলপথ নির্মাণের চুক্তিমূল্য ১০ হাজার ৩০২ কোটি টাকা। এতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে ৫১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।

এদিকে উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুনধুম রেলপথ। এ প্রকল্পের আওতায় দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১৪৪ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়। এর চুক্তিমূল্য ছয় হাজার ২৬০ কোটি টাকা। এতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে ৪৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।

একইভাবে এডিবির অর্থায়নে নির্মাণ করা হচ্ছে আখাউড়া-লাকসাম ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন রেলপথ। পাশাপাশি বিদ্যমান মিটারগেজ রেলপথটিও ডুয়েলগেজে রূপান্তর করা হচ্ছে। এতে ১৮৪ দশমিক ৬০ কিলোমিটার রেলপথের চুক্তিমূল্য তিন হাজার ৪৯৭ কোটি ৩২ লাখ টাকা। ফলে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে মাত্র ১৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। ২০১৬ সালের জুনে এ প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়।

এদিকে ভারতের অনুদানে নির্মাণ করা হচ্ছে আখাউড়া-আগরতলা ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন রেলপথ। ২০১৮ সালের মে মাসে এ প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়। ১৪ দশমিক ২৬ কিলোমিটার এ রেলপথের চুক্তিমূল্য ২৪০ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে ১৬ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। এছাড়া জাপানের ঋণে নির্মাণ করা হচ্ছে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ডাবল লাইন রেলপথ। ২০১৭ সালের জুনে এ প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়। ১৭ কিলোমিটার এ রেলপথ নির্মাণের চুক্তিমূল্য ১৬৩ কোটি টাকা। এতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে মাত্র ৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।

তথ্যমতে, ২০১৬ সালে জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডাবল লাইন ডুয়েলগেজ প্রকল্পটির প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা বা পিডিপিপি অনুমোদন করা হয়। সে সময় জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৭ হাজার ২৯৬ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। পরের বছর প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। এতে ব্যয় কিছু বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ২৩৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা। ২০১৭ সালে এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দেয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান।

যদিও চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দরকষাকষি করতে গিয়ে এ ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। ২০১৮ সালে এ ব্যয় চূড়ান্ত করা হয় ১৪ হাজার ২৫০ কোটি ৬১ লাখ টাকায়। এর মধ্যে চীন সরকার ঋণ দিচ্ছে আট হাজার ৭৫৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। বাকি পাঁচ হাজার ৪৯৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা সরকারি তহবিল থেকে সরবরাহ করা হবে।

এদিকে প্রকল্পটির ব্যয় খতিয়ে দেখতে গঠিত কমিটির হিসাবে জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণে ব্যয় হওয়া উচিত ১৪ হাজার ৩৩ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। এ হিসাবে প্রকল্পটিতে ২১৬ কোটি ৭৯ লাখ টাকা বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে। এক্ষেত্রে জমি অধিগ্রহণ, জনবল নিয়োগ, পরামর্শক, যানবাহন ও আসবাব ক্রয়, রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণে রোলিং স্টক কেনা এবং প্রকল্প ব্যবস্থা ইউনিটের ব্যয় নিয়ে কোনো বিশ্লেষণ করা হয়নি।

প্রকল্প ব্যয়ের মধ্যে শুধু নির্মাণব্যয় ১৮৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা ও ঠিকাদারের জন্য ধার্যকৃত সিডি-ভ্যাট ২৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা বেশি বলে মন্তব্য করা হয়েছে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কনটিনজেন্সি খাতে ব্যয় কিছুটা বেশি বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। যদিও খাতসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডাবল লাইন প্রকল্পটির ব্যয় প্রকৃতপক্ষে অনেক বেশি। কমিটির বিশ্লেষণে প্রকৃত চিত্র উঠে আসেনি।

তারা বলছেন, জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডাবল লাইন প্রকল্পের সঙ্গে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণের তুলনা করা ঠিক হয়নি। কারণ দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি অনেক জটিল। সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতর দিয়ে ওই রেলপথ নির্মাণ করতে হবে। আবার হাতি চলাচলের জন্য ওই প্রকল্পে বেশকিছু ওভারব্রিজ নির্মাণ করতে হবে। হাতির নিরাপত্তার জন্য রেলপথে বিশেষ ট্র্যাকিং ব্যবস্থাও থাকবে। আবার ওই প্রকল্পে হাতির খাদ্যের সংস্থানের জন্য প্রচুর বৃক্ষ রোপণের ব্যবস্থাও করতে হচ্ছে। তাই ওই প্রকল্পে গড় ব্যয় বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে আখাউড়া-লাকসাম, আখাউড়া-আগরতলা ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় অনেক কম। তাই ওই তিন প্রকল্পের সঙ্গে তুলনা করলে জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডাবল লাইন নির্মাণ ব্যয় আরও অনেক কম হওয়ার কথা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যয় পর্যালোচনা কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ২০১৮ সালের নভেম্বরে প্রকল্পটি একনেকে (জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটি) অনুমোদন করা হয়েছে। আর সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি ঠিকাদার নিয়োগ প্রস্তাব অনুমোদন করেছে ওই বছর ৫ ডিসেম্বর। গত বছর প্রকল্পটির ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি সই হয়েছে। তাই চাইলেও প্রকল্পটির ব্যয় খুব বেশি কমানো সম্ভব নয়। তবে যে ব্যয়টুকু না কমালেই নয়, শুধু সেগুলো কাটছাঁট করা হয়েছে।

সূত্র:শেয়ার বিজ, অক্টোবর ২৮, ২০২০


About the Author

RailNewsBD
রেল নিউজ বিডি (Rail News BD) বাংলাদেশের রেলের উপর একটি তথ্য ও সংবাদ ভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল।

Comments are closed.