শিরোনাম

রেলপথ নির্মাণে রাখতে হবে ইলেকট্রিক ট্রাকশনের প্রভিশন

রেলপথ নির্মাণে রাখতে হবে ইলেকট্রিক ট্রাকশনের প্রভিশন

ইসমাইল আলী: রেলওয়ের উন্নয়নে ২০১১ সালে গঠন করা হয় পৃথক মন্ত্রণালয়। গত এক দশকে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে কয়েকগুণ। এরপরও রেলের উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নতি হয়নি। এমনকি বাড়েনি ট্রেনের গতি। বরং প্রতি বছর রেলের লোকসানের পরিমাণ বাড়ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিটি রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে ইলেকট্রিক ট্রাকশনের প্রভিশন রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
ইলেকট্রিক ট্রাকশন চালু হলে ট্রেনের গতি বাড়ার পাশাপাশি পরিচালনা ব্যয় কমবে। এতে রেলের লোকসান কমবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, ইলেকট্রিক ট্রেনের ইঞ্জিন-কোচ কেনায় বিনিয়োগ লাগবে কম। আর এখন থেকে প্রতিটি প্রকল্পে ইলেকট্রিক ট্রাকশনের প্রভিশন রাখায় ভবিষ্যতে তা কার্যকর সহজ হবে।
রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন ও রেল সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেনকে সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি আরও কিছু নির্দেশনা দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে রেলওয়েকে ছয় দফা নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রণালয়।
নির্দেশনাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো নতুন রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে হাইস্পিড ট্রেন চালুর সুযোগ (প্রভিশন) রাখতে হবে। এক্ষেত্রে রেলপথের গতি হতে হবে কমপক্ষে ঘণ্টায় ১৬০ কিলোমিটার। এছাড়া নতুন রেলপথ নির্মাণের ক্ষেত্রে ইলেকট্রিক ট্রাকশনে রূপান্তরের প্রভিশন রাখতে হবে। আর চলমান প্রকল্পগুলোতেও ইলেকট্রিক ট্রাকশনের প্রভিশন যুক্ত করতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে রেলওয়ের ব্রডগেজ ট্রেনের গতি ঘণ্টায় ৬০-৭০ কিলোমিটার। আর মিটারগেজ ট্রেনের গতি আরও কম। ফলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে ৩২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে লাগে ছয় ঘণ্টার বেশি। তবে ব্রডগেজ লাইনে ইলেকট্রিক ট্রাকশন করা হলে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চালানো সম্ভব। এতে বিদ্যমান রেলপথে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে সময় লাগবে তিন ঘণ্টারও কম। তাই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেশের সব রেলপথ ইলেকট্রিক ট্রাকশন চালুর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৫ সালে ভারতে পরিচালিত যাত্রী ও পণ্যবাহী ট্রেনের ৬৫ শতাংশ ছিল ইলেকট্রিক। বাকি ৩৫ শতাংশ ছিল ডিজেলচালিত ট্রেন। আর ভারতীয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের পরিচালনা ব্যয়ের অর্ধেকে চলত ৬৫ শতাংশ ইলেকট্রিক ট্রেন। বাকি ৩৫ শতাংশ ডিজেলচালিত ট্রেনে অর্ধেক পরিচালন ব্যয় যেত। এতে ভারতের ইলেকট্রিক ট্রেনের মুনাফা থেকে ডিজেলচালিত ট্রেনে ভর্তুকি দেওয়া হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইলেকট্রিক ট্রাকশনে ব্যবহৃত ইঞ্জিন অনেক হালকা ধরনের। এগুলোর দামও ডিজেল ইঞ্জিনের চেয়ে অনেক কম। একটি ডিজেল ইঞ্জিনের দামে পাঁচটি ইলেকট্রিক ইঞ্জিন কেনা সম্ভব। এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও অনেক। আর ইলেকট্রিক ট্রেন চালাতে বিদ্যুৎও লাগে কম। বর্তমানে দেশে বিদ্যুতে উদ্বৃত্ত রয়েছে। তাই ইলেকট্রিক ট্রাকশন চালুর ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। বরং এটি চালু হলে রেলের লোকসান কমবে।
রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইলেকট্রিক ট্রাকশনের জন্য বৈদ্যুতিক খুঁটি ও তার স্থাপনে রেলপথে নির্দিষ্ট পরিমাণ ভারটিকাল (উচ্চতা) ও হোরাইজন্টাল (প্রশস্থতা) ক্লিয়ারেন্স দরকার। এছাড়া ইলেকট্রিক ট্রাকশনের ক্ষেত্রে রেলপথে কোনো লেভেল ক্রসিং রাখা যাবে না। তাই রেলপথ নির্মাণে ইলেকট্রিক ট্রাকশনের প্রভিশন রাখতে হলে প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রেই পরিকল্পনা দরকার। তা না হলে পরে সেটা বাস্তবায়ন অনেক কঠিন হবে।
তাদের আরও বলছেন, নতুন রেলপথ নির্মাণের ক্ষেত্রে হাইস্পিড ট্রেনের প্রভিশনও এখন থেকেই রাখা জরুরি। কারণ রেল ব্যবস্থার উন্নয়নে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। অনেক দেশ এরই মধ্যে উচ্চ গতির ট্রেন চালু করেছে। বাংলাদেশেও হাইস্পিড ট্রেন চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। সেক্ষেত্রে পুনরায় জমি অধিগ্রহণে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। তাই হাইস্পিড ট্রেনের প্রভিশন রেখে নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা হলে পরবর্তীতে জমি অধিগ্রহণ খাতে কোনো ব্যয় হবে না।
সূত্রমতে, বর্তমানে চলমান বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্যে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ ও দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণে এখনই ইলেকট্রিক ট্রাকশনের প্রভিশন যুক্ত করার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কারণ এ প্রকল্প দুটির নির্মাণকাজ এখনও শুরু হয়নি। এছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হাইস্পিড রেলওয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্দেশনাও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। যদিও প্রাথমিকভাবে ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইস্পিড ট্রেন চালুর পরিকল্পনা নিয়েছিল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
প্রধানমন্ত্রীর অন্যান্য নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে ১৯৬৫ সালে যুদ্ধের সময় প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হওয়া রেল লিংকগুলো পুনঃসংযোগ স্থাপনের ব্যবস্থা গ্রহণ, চট্টগ্রাম-দোহাজারি লাইনে অবস্থিত কর্ণফুলী সেতুটি ডেডিকেটেড (শুধু) রেল সেতু করতে হবে এবং ঢাকা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত তৃতীয় ও চতুর্থ রেললাইন নির্মাণের ক্ষেত্রে টঙ্গী রেল সেতুটির উচ্চতা দুই মিটার বাড়াতে হবে।
রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিটি নির্দেশনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে রেলওয়েকে লোকসানের বোঝা থেকে মুক্ত করতে ও রেলপথের গতি বাড়াতে ইলেকট্রিক ট্রাকশনের বিকল্প নেই। আর ২০৪১ সালে উন্নত দেশের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সে সময় জনগণের মাথাপিছু আয় অনেকটা বেড়ে যাবে। ফলে দ্রুত রেল যোগাযোগ চালু করতে হাইস্পিড ট্রেন দরকার হবে।
এদিকে কর্ণফুলী রোড কাম রেল সেতু হওয়ায় বিদ্যমান সেতুর অবস্থা খুবই নাজুক হয়ে পড়েছে। তাই নতুন সেতুটি ডেডিকেটেড রেল সেতু হলে এটির স্থায়ী বাড়বে ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমবে। আর টঙ্গী রেল সেতুসহ কয়েকটি সেতুর উচ্চতা কম হওয়ায় ঢাকার চারপাশে বৃত্তাকার নৌপথ ব্যবহার করা যাচ্ছে না। তাই নতুন টঙ্গী রেল সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে উচ্চতা বাড়ানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

সুত্র:শেয়ার বিজ


About the Author

RailNewsBD
রেল নিউজ বিডি (Rail News BD) বাংলাদেশের রেলের উপর একটি তথ্য ও সংবাদ ভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল।

Comments are closed.