শিপন হাবীব :
পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে উন্নয়ন সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে স্থাপিত ১৩৮ কিলোমিটার মিটারগেজ রেলপথ ভেঙে ফেলতে হবে। এজন্য প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা জলে যাবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের ঢাকা-লাকসাম রুট হয়ে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা ব্যয়ে হাইস্পিড লাইন নির্মাণ সমীক্ষার ১১০ কোটি টাকাও জলে গেছে। নতুন করে আবার প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছে রেলওয়ে। ৫৩ বছর আগে এ রুটে কর্ডলাইন (ইলেকট্রিক ট্র্যাকশন) নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি। সংশ্লিষ্টদের অভিমত-এ কর্ডলাইন বাস্তবায়নেই সুফল মিলবে।
রেলওয়েসংশ্লিষ্টরা জানান, অপরিকল্পিত আর সুদূরপ্রসারবিহীন প্রকল্প বাস্তবায়নে সাধারণ মানুষ কোনো সুফল পাবে না। এতে সরকারের শুধুই অর্থের অপচয় হবে। তারা বলেন, ৫৩ বছর আগে ঢাকা-লাকসাম কর্ডলাইন নির্মাণের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল তা বাস্তবায়ন হলেই সুফল মিলবে। ইলেকট্রিক ট্র্যাকশন কর্ডলাইন বাস্তবায়নে বেশ কয়েকবার প্রাথমিক সমীক্ষাও করা হয়। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য কারণে এ প্রকল্পের দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে না।
রেলপথ মন্ত্রণালয় হওয়ার পর চারজন মন্ত্রী দায়িত্ব পালন করলেও কর্ডলাইন বাস্তবায়ন হয়নি। অথচ রেলওয়ে ট্রাফিক ও বাণিজ্যিক বিভাগ বলছে-এ পথ বাস্তবায়ন হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে মাত্র ২ ঘণ্টায় চলাচল করা সম্ভব। বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ লাইনে ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা (শুধু আন্তঃনগর ট্রেন) সময় লাগছে। আর লোকাল-মেইলে সময় লাগছে দ্বিগুণেরও বেশি। নতুন ইঞ্জিন-কোচ আনা হলেও প্রকৃত গতির চেয়ে অর্ধেকেরও কম গতি নিয়ে ট্রেন চলছে।
রেলওয়ে পরিকল্পনা দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের দূরত্ব ৩২৪ কিলোমিটার। এ পথে ঢাকা-লাকসাম প্রায় ৯০ কিলোমিটার নতুন কর্ডলাইন নির্মাণ হলে ঢাকা-চট্টগ্রামের দূরত্ব প্রায় ১২০ কিলোমিটার কমে ২০৪ কিলোমিটারে দাঁড়াবে। কর্ডলাইনে মিটারগেজ ও ব্রডগেজ উভয় ট্রেন চলাচল করতে পারবে। এটি বাস্তবায়ন হলে মিটারগেজে ৩ ঘণ্টা ও ব্রডগেজে মাত্র ২ ঘণ্টায় বিরামহীম ট্রেন সার্ভিস দেওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু ঢাকা-চট্টগ্রাম লাইনে সদ্যনির্মিত লাইন ভেঙে নতুন করে লাইন নির্মাণেও গতি বাড়বে না। বরং এসব অপরিকল্পিত প্রকল্প বাস্তবায়নে দেড় থেকে দুই যুগ পার হয়ে যাবে। আর কর্ডলাইন নির্মাণ করতে সাড়ে ৩ থেকে ৪ বছর সময় লাগবে।
জানা যায়, ১৯৬৯ সালে ঢাকা-লাকসাম কর্ডলাইন নির্মাণে পরিকল্পনা ও সমীক্ষা সম্পন্ন হয়। এতে বলা হয়, লাকসাম থেকে নারায়ণগঞ্জ হয়ে ঢাকা পর্যন্ত কর্ডলাইন নির্মাণ হলে ঢাকা-চট্টগ্রামে মাত্র ২ ঘণ্টায় ভ্রমণ সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে রেল অবকাঠামোতে চট্টগ্রাম থেকে একটি আন্তঃনগর ট্রেন কুমিল্লা, লাকসাম, আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আশুগঞ্জ, ভৈরব, নরসিংদী, টঙ্গী, বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন হয়ে বৃত্তাকার পথে ঘুরে ঢাকায় পৌঁছতে ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা সময় লাগে। ঢাকা-লাকসাম কর্ডলাইনটি নির্মাণ হলে বর্তমান গতিতে ট্রেন চললেও সময় লাগবে মাত্র ৩ ঘণ্টা। কর্ডলাইনে সর্বোচ্চ ১৬০ কিলোমিটার গতি নিয়ে ট্রেন চলতে পারবে। এতে ২ ঘণ্টারও কম সময় লাগবে। কর্ডলাইনের সঙ্গে লাকসাম থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত লাইন ইলেকট্রিক ট্র্যাকশন করে নিলেই হবে, যা ওই পথে চলমান লাইনকে খুব সহজে কর্ডলাইনে পরিণত করা সম্ভব।
রেলওয়ে পরিকল্পনা দপ্তর সূত্রে জানা যায়, সর্বশেষ ২০০৬ সালে ঢাকা-লাকসাম কর্ডলাইন নির্মাণ সমীক্ষাসম্পন্ন করে এসএম এএমইসি ইন্টারন্যাশনাল পিটি লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এতে বলা হয়- এ লাইন নির্মাণে ২৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা (৩ বিলিয়ন ইউএস ডলার) ব্যয় হবে। ব্রডগেজ ডিজাইন স্পিড ১৬০ কিলোমিটার হবে। এতে যাত্রী ও মালবাহী উভয় ট্রেন চলাচল করতে পারবে। অথচ হাইস্পিড লাইন নির্মাণ করতে হলে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা ব্যয় হবে।
এদিকে, রেলওয়ে পরিকল্পনা দপ্তরের তৈরি একটি ছকে দেখানো হয়েছে-একই রুট হয়ে হাইস্পিড লাইনে চলাচল করতে মাত্র সোয়া ঘণ্টা (৭৫ মিনিট) সময় লাগবে। তবে এটি নির্মাণ করতে ১০ থেকে ১২ বছর সময় লাগতে পারে। অর্থের জোগানও অনিশ্চিত। নতুন রোলিং স্টক লাগবে এবং এর মেরামত কারখানা নির্মাণ করতে হবে। স্ট্যান্ডার্ড গ্যারেজের জন্য নতুন রোলিং স্টকেরও প্রয়োজন হবে। এছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনে কার্বন নিঃসরণ হবে। হাইস্পিড লাইনে মালবাহী ট্রেন পরিচালনা করা যাবে না।
অপরদিকে কর্ডলাইনে চলাচল করতে প্রায় ২ ঘণ্টা সময় লাগবে। নির্মাণ করতে সময় লাগবে সাড়ে তিন থেকে চার বছর। এডিবি থেকে অর্থের সংস্থান হবে। বিদ্যমান রোলিং স্টক দিয়ে প্রাথমিকভাবে ট্রেন চালানো সম্ভব। এ কারণে রোলিং স্টক মেরামত কারখানার প্রয়োজন হবে না। যাত্রী ও মালবাহী উভয় ট্রেন চালানো যাবে। কর্ডলাইন হলে ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে একই ট্রেন দিয়ে ডাবল ট্রিপ দেওয়া যাবে। ফলে বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ যাত্রী পরিবহণ করা যাবে। বর্তমানের চেয়ে যাত্রীদের কম ভাড়াও গুনতে হবে। এছাড়া এ পথে বৈদ্যুতিক ইঞ্জিন চালানো সম্ভব। কর্ডলাইনে ঘণ্টায় ১৬০ কিমি গতিতে ট্রেন চালানো যাবে। বর্তমানে ঘণ্টায় ৩৪ থেকে ৬৬ কিলোমিটার গতি নিয়ে ট্রেন চলে।
রেলওয়ে পরিকল্পনা, প্রকৌশল, বাণিজ্যিক, অবকাঠামো দপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে নিরাপদ ও কম সময়ের মধ্যে ট্রেন চালাতে কর্ডলাইনের কোনো বিকল্প নেই। এ রুটের টঙ্গী থেকে ভৈরব পর্যন্ত নতুন নির্মিত মিটারগেজ লাইন ভেঙে ফেলতে হবে। যা কয়েক বছর আগে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকায় তৈরি হয়েছিল। এ পথেই আবার প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ডুয়েলগেজ ডাবললাইন নির্মাণে ঝুঁকছে রেল। এর ওপর আবার ২ লাখ কোটি টাকা ব্যয়ে হাইস্পিড লাইন তৈরির দিকে যাওয়া হচ্ছে। এত অল্প দূরত্বে হাইস্পিড লাইন পৃথিবীর কোনো দেশে নেই।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আরও জানান, হাইস্পিড লাইন রক্ষণাবেক্ষণে বছরে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। এ লাইনে টিকিটের দাম হবে বিমান ভাড়ার কাছাকাছি। ফলে হাইস্পিড ট্রেনে আশানুরূপ যাত্রী কখনোই পাওয়া যাবে না। বিমানের সমান ভাড়া হলে হাইস্পিড ট্রেনে সাধারণ যাত্রীদের যাতায়াত কিছুতেই সম্ভব হবে না। কর্ডলাইন হলে বর্তমান ভাড়ার (যথাক্রমে ৯০ থেকে ১১৭৯ টাকা) চেয়ে আরও কম মূল্যে যাত্রীরা যাতায়াত করতে পারবেন। ফলে ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন কিংবা হাইস্পিড লাইন প্রকল্পে বড় বিনিয়োগ করলে রেল আরও লোকসানের মুখে পড়বে। বর্তমানে রেল বছরে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা লোকসান গুনছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক যুগান্তরকে জানান, রেলে যে সব উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন হচ্ছে-সেগুলোর অনেকটি প্রকৃত উন্নয়নের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। রেল এখন শুধু প্রকল্প গ্রহণে ব্যস্ত। সুদূরপ্রসারী কোনো পরিকল্পনা নেই। রেলপথ এখনও চরম ঝুঁকিতে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ৪০ হাজার কোটি টাকায় ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন অথবা প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা ব্যয়ে হাইস্পিড লাইন নির্মাণ শেষে ট্রেন পরিচালনায় সাধারণ যাত্রীরা চলতে পারবেন কিনা? এতে লোকসান আরও দ্বিগুণের চেয়ে বেশি দাঁড়াবে। অথচ অল্প খরচে ও অল্প সময়ে কর্ডলাইন নির্মাণ সম্ভব। এতে সাধারণ যাত্রীরাও সহজে ভ্রমণ করতে পারবেন। রেলের আয় বাড়ার সঙ্গে সেবাও বাড়বে। রেলে আমূল পরিবর্তন আনতে কর্ডলাইন, ইলেকট্রিক ট্র্যাকশনের কোনো বিকল্প নেই।
রেলওয়ে মহাপরিচালক ডিএন মজুমদার যুগান্তরকে জানান, কর্ডলাইন নির্মাণের দিকেই আমরা যাচ্ছি। তার একমাত্র কারণ-ব্যয় কমিয়ে উন্নত সেবা দেওয়া সম্ভব। ভাড়া কমে আসলে সাধারণ যাত্রীরাও ভ্রমণে উৎসাহিত হবেন। তবে কিছু জরাজীর্ণ লাইন মেরামত, অবৈধ লেভেলক্রসিং বন্ধ করতে হবে। মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন-কোচ পালটানোসহ বন্ধ স্টেশন চালু করতে হবে।
রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান সরকার রেল উন্নয়নে আমূল পরিবর্তন আনছে। আমরা রেলকে অত্যাধুনিকভাবে সাজাচ্ছি। তিনি বলেন, ঢাকা-লাকসাম কর্ডলাইনের কোনো বিকল্প নেই। এটি নির্মাণে আমরা বিশেষভাবে কাজ করছি। তবে ২০০৬ সালে যে সমীক্ষা হয়েছে তা আপডেট করা হচ্ছে।
রেলপথমন্ত্রী সুজন আরও বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইস্পিড লাইন নির্মাণ প্রকল্পের সমীক্ষা শেষ হলেও আমরা এ মুহূর্তে হাইস্পিড লাইন নির্মাণের দিকে যাচ্ছি না। কারণে এতে ব্যয় অনেক বেশি। অর্থায়নেও অনিশ্চয়তা রয়েছে। কর্ডলাইন নির্মাণে অর্থের জোগান পাওয়া যাবে। আমরা এখন এদিকেই এগোচ্ছি। আরও অনেক আগেই কর্ডলাইন নির্মাণের প্রয়োজন ছিল বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সূত্র:যুগান্তর