শিরোনাম

এত খরচেও গতিহারা ট্রেন


।। রেল নিউজ ।।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে রেলওয়েকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। গত ১৩ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটিকে ১ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে পরিচালন বাবদ খরচ হয়েছে ৩০ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। এত বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের পরও এই সময়ে ট্রেনের গতি বাড়েনি। বরং দিন দিন গতি কমে আসছে। ৩০ হাজার ২৮০ কোটি টাকা পরিচালন ব্যয়ের বিপরীতে আয় হয়েছে মাত্র ১৩ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ শুধু ট্রেন চালিয়ে রেলওয়ের লোকসান ১৬ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা।

সড়কপথের তুলনায় খরচ কম হলেও রেলে সময় লাগে বেশি। ঢাকার কমলাপুরের আইসিডি থেকে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত মালামাল পৌঁছাতে তিন দিন লেগে যায়। এর ব্যাখ্যায় রেলকর্তারা বলছেন, যাত্রীবাহী ট্রেনকে প্রাধান্য দিতে পণ্যবাহী ওয়াগনকে অগ্রাধিকার দেওয়া যায় না।

রেলের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ট্রেনে গতি বৃদ্ধি তথা ভ্রমণ সময় কমানো সংস্থাটির অগ্রাধিকার। কিন্তু দেশের প্রধান রেলপথ ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ‘সুবর্ণ এক্সপ্রেস’র সর্বনিম্ন ৫ ঘণ্টা ২০ মিনিট লাগে। মাঝে ৫ মিনিট বিরতি বাদে ট্রেনটি

গড়ে ৬১ কিলোমিটার গতিতে চলে। সুবর্ণই দেশের সবচেয়ে দ্রুতগতির ট্রেন। অথচ ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের দুটি অংশ ডাবললাইনে উন্নীত হওয়ার আগে, ২০০৯ সালেও ট্রেনটি সাড়ে চার ঘণ্টায় চট্টগ্রামে পৌঁছাত।

‘মহানগর’, ‘তূর্ণা’সহ অন্যান্য আন্তঃনগর ট্রেন ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ৬ ঘণ্টা ১০ মিনিট থেকে সাড়ে ৭ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগে। রেলের সময়সূচি অনুযায়ী, ঢাকা থেকে রাত ৯টা ২০ মিনিটে যাত্রা করে ভোর ৪টা ৫০ মিনিটে চট্টগ্রামে পৌঁছে মহানগর এক্সপ্রেস। পথে ১২টি স্টেশনে ৩৪ মিনিট যাত্রাবিরতি করে। এ হিসাবে ট্রেনটি গড়ে ৪৫ কিলোমিটার গতিতে চলে। তবে এ হিসাবেও ফাঁকি রয়েছে। রেলওয়ের সভার কার্যবিবরণী অনুযায়ী, ২০২১ সালের এপ্রিলে ৮৫ শতাংশ সময়সূচি মেনে চলেছে ট্রেন। এ বছরের একই মাসে ৮৭ শতাংশ ট্রেন সময় অনুযায়ী চলাচল করে।

তবে রেল সূত্র বলছে, পুরো হিসাবই শুভঙ্করের ফাঁকি। একটি ট্রেন রেলের এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে আধাঘণ্টা বিলম্বে পৌঁছালেও তা নির্ধারিত সময়েই এসেছে বলে বলা হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রাম রেলের পূর্বাঞ্চলের আলাদা দুটি বিভাগ। তাই ট্রেন এক ঘণ্টা দেরি করলেও নির্ধারিত সময়ে চলেছে বলে দেখানো হয়।

ট্রেনের রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার সাহাদাত আলীর দাবি, সিঙ্গেল লাইন হওয়ার কারণে ট্রেনের গতি কম। আগের তুলনায় ট্রেনের গতি কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে কর্মকর্তারা বলছেন আন্তঃনগর ট্রেনের সংখ্যা ও স্টপেজ বৃদ্ধি।

জানা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম ৩২১ কিলোমিটার রেলপথের ২৪৯ কিলোমিটার এখন ডাবললাইনের। ২০০৭ সালে অনুমোদিত প্রকল্পের আওতায় লাকসাম থেকে চিনকি আস্তানা পর্যন্ত ৬১ কিলোমিটার ডাবললাইন রেলপথ ২০১৫ সালের এপ্রিলে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরের বছরের ফেব্রুয়ারিতে তিনি উদ্বোধন করেন, টঙ্গী থেকে ভৈরববাজার পর্যন্ত ৬৪ কিলোমিটার ডাবললাইন রেলপথ, যা ২০০৫ সালে অনুমোদিত প্রকল্পের অধীনে নির্মাণ করা। প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা খরচ করে এই দুই প্রকল্প বাস্তবায়নেও রেলের গতি বাড়েনি।

গত ১৩ বছরে ৫০০ কিলোমিটার নতুন রেললাইন নির্মাণ হয়েছে। ২৮৭ কিলোমিটার রেলপথ ডাবললাইনে উন্নীত করা হয়েছে। ১ হাজার ২৭১ কিলোমিটার রেলপথ পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। কেনা হয়েছে ৭৪টি ইঞ্জিন, ৫২০টি যাত্রীবাহী বগি এবং ৪৬০টি পণ্যবাহী ওয়াগন। রেল মন্ত্রণালয়ের ‘সাফল্যের’ তালিকায় রয়েছে ৬৪৮ কোটি ২০ সেট ডেমু ট্রেন কেনার তথ্য। অথচ সেগুলো বিকল। এখন সেগুলো মেরামত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

৪০টি আন্তঃনগরসহ ১৪৮টি নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে ১৩ বছরে। ১৩ হাজার ৯৮১ জন কর্মী নিয়োগ করা হয়েছে। নবনির্মিত লাইনগুলোতে ১০০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলতে সক্ষম বলে দাবি করছে রেল। কিন্তু ৭২ কিলোমিটারের বেশি গতিতে ট্রেন চালানোর নজির নেই। আগে দায়ী করা হতো, পুরনো ইঞ্জিনকে। কিন্তু চলতি বছরের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ৪৬টি ইঞ্জিন উদ্বোধন করেছেন, সেগুলোতেও ৬০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে ট্রেন চলছে না। এখন বলা হচ্ছে, রেললাইন পুরনো।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২ হাজার ৫৮ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ ও পুনর্বাসন করা হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের টঙ্গী-ভৈরববাজার এবং চিনকি-আস্তানা অংশে ৬ ও ৭ বছর আগে নির্মিত রেললাইনটিতে নতুন ইঞ্জিনেও ট্রেন ৬০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে ট্রেন চলে না। তথ্যানুযায়ী, মহানগর এক্সপ্রেস মাঝে ২ মিনিট বিরতিসহ কমপক্ষে ১ ঘণ্টা ৮ মিনিটে টঙ্গী থেকে ৬৪ কিলোমিটার দূরের ভৈরববাজারে যায়। গতি ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটারেরও কম।

১৯১৭ ও ১৯১৮ সালে নির্মিত ময়মনসিংহের গৌরীপুর থেকে শ্যামগঞ্জ হয়ে নেত্রকোনা থেকে মোহনগঞ্জ পর্যন্ত সাড়ে ৭৮ কিলোমিটার রেলপথ ২০১৩ সালে পুনর্বাসন করা হয় ১৮১ কোটি টাকায়। বলা হয়েছিল, ৬০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলবে। তবে রেলের সময়সূচি অনুযায়ী, হাওর এক্সপ্রেস ১ ঘণ্টা ৪২ মিনিটে গৌরীপুর থেকে মোহনগঞ্জ যায়। গতি ঘণ্টা ৪৫ কিলোমিটার। যদিও এ হিসাব কাগজ-কলমে। দুই থেকে আড়াই ঘণ্টায় গৌরীপুর থেকে ট্রেন যায় মোহনগঞ্জ। ২০১৫ সালে গতি ছিল ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার।

দুই হাজারের কিলোমিটারের বেশি রেলপথ নির্মাণ ও পুনর্বাসন হলেও ট্রেন লাইনচ্যুতি কমেনি। রেলের তথ্যানুযায়ী, ২০১৫ সালে মূল লাইনে ৬৬টি ট্রেন দুর্ঘটনার মধ্যে ৩৯টি ছিল লাইনচুত্যি। ২০২১ সালের প্রথম ছয় মাসে ২৪টি দুর্ঘটনার মধ্যে ১৮টির কারণ ছিল লাইনচ্যুতি। তার আগের বছরে ৪৫টি দুর্ঘটনার ২৯টি ঘটে লাইনচ্যুতিতে। বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেছেন, লাইনচ্যুতির প্রধান কারণ রেলপথের ত্রুটি।
রেলের বহরে ১৭১টি মিটারগেজ এবং ৯২টি ব্রডগেজসহ ২৬৩টি ইঞ্জিন রয়েছে। এর মধ্যে ১৪টি মিটারগেজ ইঞ্জিন অচল। বাকি ২৪৯টি ইঞ্জিনের ৬৭ শতাংশের আয়ুষ্কাল ফুরিয়েছে। ১ হাজার ৬৭১টি যাত্রীবাহী বগির ৪৭ শতাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ।

আবার নতুন কেনা বগিও নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। এডিবির ঋণে হুন্দাই রোটেমের কাছ থেকে না ১০টি মিটারগেজ ইঞ্জিনে চুক্তি অনুযায়ী যন্ত্রাংশ দেওয়া না হলে, প্রকল্প পরিচালক তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালেও রেলওয়ে তা বহরে যোগ করে।

প্রকল্পের অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত করছে দুদক। ইঞ্জিন কেনার তদারকিতে থাকা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ভুয়া সনদ দিয়ে ধরা পড়লেও সংস্থাটিকে বিল দিতে চলতি মাসেও চেষ্টা করে রেল। কিন্তু প্রকল্প মেয়াদ শেষ হয়েছে, যুক্তিতে তা আটকে দেয় হিসাব বিভাগ।

ইন্দোনেশিয়া থেকে আনা বগির মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ধারণক্ষমতার বেশি যাত্রী ট্রেনের ছাদে ওঠায় এবারের ঈদযাত্রাতেও নতুন বগির স্ট্রিংগার বসে যাওয়ার ঘটনা ঘটে।

লেখা- তাওহীদুল ইসলাম
সূত্রঃ আমাদেরসময়


Comments are closed.