শিপন হাবীব :
দেশে প্রাণঘাতী কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় ট্রেনগুলোকে ব্যবহারের কথা ভাবছে রেলওয়ে। প্রতিবেশী ভারতে এ ধরনের উদ্যোগ নেয়ার পর বাংলাদেশ রেলওয়েও বিষয়টি নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। দেশের ৯৮টি আন্তঃনগর ট্রেনের প্রায় ১৫০০ কেবিনকে ‘আইসোলেশন ওয়ার্ড’ ঘোষণার কথা মাথায় রেখে এগোচ্ছে রেল মন্ত্রণালয়। সাম্প্রতিক সময়ে আনা কোচগুলোর কেবিনসমূহে সব ধরনের আধুনিক সুবিধাই রয়েছে। প্রতিটি কেবিনে একজন রোগীকে চিকিৎসা দেয়া হলে এই কেবিনগুলোয় বহু করোনা রোগীর চিকিৎসা দেয়া সম্ভব। করোনা ঠেকাতে সরকার ইতোমধ্যে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে এসব ট্রেন দেশের বিভিন্ন স্থানে অলস বসে আছে। তবে করোনা রোগীদের চিকিৎসায় বাংলাদেশ রেলওয়ে ইতোমধ্যে দুটি বড় হাসপাতাল প্রস্তুত করেছে। পর্যায়ক্রমে রেলের অন্য হাসপাতালগুলোও করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত করা হবে বলে জানা গেছে।
কথা হয় রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, করোনা ঠেকাতে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেয়া ছাড়া বিকল্প নেই। আমরা ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম ও কমলাপুর রেলওয়ে হাসপাতালকে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত করেছি। ভারত দূরপাল্লার এক্সপ্রেস ট্রেনগুলোর কেবিনকে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত করছে। বিষয়টি নিয়ে আমরাও ভাবছি। পরিস্থিতি ভয়াবহর দিকে গেলে আমরা দূরপাল্লার ট্রেনের কেবিনগুলোকে প্রস্তুত করব। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে সর্বোচ্চ উদ্যোগ নেয়া হবে। ট্রেনগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে। অলস পড়ে থাকা ট্রেনগুলোর কেবিন ব্যবহার করে যদি করোনা আক্রান্তদের সেবা দেয়া যায়, তাহলে সেটি হবে সবচেয়ে ভালো উদ্যোগ। কেবিনগুলো কী করে প্রস্তুত করা যায় এবং সেখানে কীভাবে আক্রান্তদের চিকিৎসা দেয়া হবে, তা নিয়ে প্রয়োজনে ভারতের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।
জানতে চাইলে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক মিহির কান্তি গুহ যুগান্তরকে জানান, ২৫ মার্চ থেকে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। আন্তঃনগর ট্রেনগুলো বিভিন্ন ওয়াসফিটে-স্টেশনে এখন বসা। ভারতের ন্যায় যদি ট্রেনের কেবিনগুলোয় আক্রান্তদের সেবার ব্যবস্থা নেয়া হয়, তাহলে নির্দেশনা মোতাবেক কাজ করা হবে।
তিনি বলেন, এ অঞ্চলে ৫২টি আন্তঃনগর ট্রেন রয়েছে। একটি কোচে ৮টি করে কেবিন। ৫২টি ট্রেনে কেবিন সংখ্যা ৮৩২টি। সাম্প্রতিক সময়ে যেসব অত্যাধুনিক কোচ আনা হয়েছে, সেগুলোর কেবিন কোচগুলো খুবই উন্নত। কেবিনগুলো বেশ বড়, প্রতি কোচে অত্যাধুনিক ২টি টয়লেট আছে। পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান মেকানিক্যাল কর্মকর্তা এফএম মহিউদ্দিন যুগান্তরকে জানান, শুধু ভারত নয়, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে ট্রেনের কেবিনগুলোকে আইসোলেশন ওয়ার্ড করেছে। আমাদের পূর্বাঞ্চলে প্রায় ৬০টি আন্তঃনগর ও প্রথম শ্রেণির ট্রেন রয়েছে। কিছু কিছু ট্রেন ৩-৪টি কেবিন কোচ রয়েছে। সে হিসাবে ট্রেনগুলোয় প্রায় হাজারের উপরে কেবিন আছে। চিকিৎসা দিতে হলে সর্বোচ্চ নির্দেশনায় যথাযথভাবে কেবিনগুলোকে প্রস্তুত করতে হবে।
সার্বক্ষণিক বিদ্যুতের ব্যবস্থাসহ ডাক্তার-নার্সদের জন্যও আলাদা কোচ নির্ধারণ করতে হবে। তিনি বলেন, করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসায় মালয়েশিয়া- ইন্দোনেশিয়ায় নতুন করে কোচ তৈরি করা হচ্ছে। মহিউদ্দিন বলেন, এ বিষয়ে আমাদের যে সক্ষমতা রয়েছে তার সঙ্গে প্রয়োজনে- যেসব দেশ ইতোমধ্যে এমনটা করেছে তাদের পরামর্শ নেব। আমাদের লোকবল তথা কারখানা-মেকানিক্যালের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে শ্রমিকরা নিজ নিজ হেডকোয়ার্টারে আছেন। সরকারের নির্দেশ পেলে আমরা এ বিষয়ে কাজ শুরু করতে পারব। তিনি বলেন, বর্তমানে সব ট্রেন বন্ধ রয়েছে। এগুলোর মধ্য থেকে নির্ধারিত ট্রেনগুলোর কেবিনে ‘কোয়ারেন্টিন বা আইসোলেশন কোচ’ প্রস্তুত করতে হলে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম-লোকবল প্রয়োজন পড়বে। টয়লেটগুলোকে সম্পূর্ণ গোসলের উপযোগী করতে হবে। এ বিষয়ে রেলওয়ের মহাপরিচালক শামছুজ্জামান বুধবার বিকালে যুগান্তরকে জানান, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে দূরপাল্লার ট্রেনের কেবিন ব্যবহার করে করোনা আক্রান্তদের সেবায় কোয়ারেন্টিন কিংবা আইসোলেশন কোচ তৈরি করা হচ্ছে। নির্দেশনা পেলে আমরা সেই দিকে যাব। বন্ধ থাকা ট্রেনগুলোর কেবিন ব্যবহার করে যদি দেশের কল্যাণে, দেশের মানুষের কল্যাণে কিছু করা যায়, তাহলে নিশ্চয় সেটা হবে। রেলপথ সচিব মোফাজ্জেল হোসেন বলেন, আমাদের দেশে এখনও করোনা মহামারী আকারে বিস্তার হয়নি। তবে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেই প্রস্তুতির অংশ হিসেবে যদি ট্রেনের কেবিনগুলো প্রস্তুত করতে বলা হয়, তাহলে আমরা সেটাই করব। আমরা এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করছি। সরকারের নির্দেশনায় আমরা কাজ করব।
রেলের দুই হাসপাতাল প্রস্তুত : করোনা রোগীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে চট্টগ্রামের সিআরবির রেলওয়ে বক্ষব্যাধি হাসপাতাল। ৫০ শয্যার এই হাসপাতালে কোনো রোগী নেই। ৩৭টি বেড প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে এসব বেডে পর্যাপ্ত সরঞ্জাম বা যথাযথ উপকরণ নেই। স্বাস্থ্য বিভাগকে একটি চাহিদাপত্রও দিয়েছে রেলওয়ের স্বাস্থ্য বিভাগ। পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা (সিএমও) ডা. সামশুল আলম মো. ইমতিয়াজ বুধবার যুগান্তরকে বলেন, আমাদের হাসপাতালে কোনো রোগী নেই। আমরা ৩৭টি বেড প্রস্তুত করে রেখেছি। তবে চিকিৎসা সরঞ্জাম নেই। চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন বলেছেন, রোগী ভর্তি হওয়ার আগেই সবকিছুই চলে আসবে। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. শেখ ফজলে রাব্বি সাংবাদিকদের জানান, করোনাভাইরাসের কারণে প্রাথমিকভাবে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক হোম কোয়ারেন্টিনের জন্য সিআরবির রেলওয়ে হাসপাতালটি প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এদিকে ৫৫ শয্যার রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতালের অতিরিক্ত বিভাগীয় কর্মকর্তা ডা. তুহিন বিনতে হালিম বুধবার বিকালে যুগান্তরকে জানান, হাসপাতালটির দ্বিতীয় তলায় দুটি বড় ওয়ার্ড এবং ১৬টি কেবিনসহ মোট ৫৫টি বেড প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে কোনো বেডেই চিকিৎসা সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি বসানো হয়নি। চাহিদাপত্র দিয়েছি, আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যেই এসব পেয়ে যাব। আমাদের এ হাসপাতালে পর্যাপ্ত ডাক্তার যেমন নেই, নেই নার্সসহ লোকবলও।
সুত্র:যুগান্তর, ০৬ এপ্রিল ২০২০