শিরোনাম

সিগন্যালের ভিন্নতায় বিভ্রান্ত চালক, বাড়ছে ট্রেন দুর্ঘটনা

সিগন্যালের ভিন্নতায় বিভ্রান্ত চালক, বাড়ছে ট্রেন দুর্ঘটনা

জেসমিন মলি ও শামীম রাহমান :

ঝিনাইদহের সাফদারপুরে গত বছরের ২৭ অক্টোবর দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। ট্রেন দুটির একটি ছিল মালবাহী, অন্যটি জ্বালানি তেলবাহী। এ ঘটনায় নষ্ট হয় ১ লাখ ৫০ হাজার লিটার জ্বালানি তেল। দুটি ট্রেনই বাতিল হয়ে যায়। ট্রেন দুটির ইঞ্জিন ও দুর্ঘটনাস্থলের রেললাইন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তদন্তে বেরিয়ে আসে সিগন্যাল অমান্য করায় এ দুর্ঘটনা ঘটে, যার দায় দেয়া হয় রেলওয়ের যান্ত্রিক বিভাগকে।

এর আগে ২০১৯ সালের নভেম্বরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মন্দবাগে দুটি যাত্রীবাহী ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে মৃত্যু হয় ১৭ যাত্রীর। এখানেও দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে চালকের সিগন্যাল অমান্য করার বিষয়টি তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে।

সিগন্যাল অমান্য কিংবা সিগন্যালের ভুলের কারণে কিছুদিন পর পরই দেশে ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটছে। এতে যেমন হতাহতের ঘটনা ঘটছে তেমনি রেলওয়ের অবকাঠামোও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ ধরনের দুর্ঘটনার জন্য সিগন্যাল ব্যবস্থার ভিন্নতাকে অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চল। সম্প্রতি ট্রেন দুর্ঘটনার কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে উপস্থাপন করে রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চল। রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল থেকেও দুর্ঘটনার বিভিন্ন কারণ চিহ্নিত করে আরেকটি প্রতিবেদন সংসদীয় কমিটির বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়।

রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন স্টেশনের সিগন্যালে সিবিআই কালার লাইট, নন-ইন্টারলকড কালার লাইট, সিমাফোর আপার কোয়াড্রেন্ট, সিমাফোর লোয়ার কোয়াড্রেন্ট, কেরোসিন বাতি, সোলার প্যানেল, বৈদ্যুতিক বাতিসহ নানা ধরনের সিগন্যালিং সিস্টেম ও সিগন্যাল বাতির রাত্রিকালীন উজ্জ্বলতার তারতম্যের কারণে ট্রেনের চালকরা (লোকোমাস্টার) বিভ্রান্ত হচ্ছেন। সিগন্যালের ভিন্নতাকে রেল দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। পাশাপাশি  বলা হয়েছে, ক্রু-স্বল্পতার কারণে রানিং স্টাফদের যথাযথ বিশ্রাম না হওয়া, অপারেটিং স্টাফদের ওভার ডিউটির কারণে সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে ট্রেন পরিচালনা, প্রকৌশল বিভাগের কর্মীদের বিধি অমান্য করে সংশ্লিষ্টদের না জানিয়ে লাইনে কাজ করা, ম্যাটেরিয়াল ট্রলি, পুশ ট্রলি রেললাইনে স্থাপন ও কাজ সম্পন্ন না করে বিপরীতে যাওয়ার কারণে দুর্ঘটনা হচ্ছে।

বাংলাদেশ রেলওয়েতে সব মিলিয়ে স্টেশন আছে ৪৮৩টি। এর মধ্যে সিগন্যাল ব্যবস্থাসংবলিত স্টেশনের সংখ্যা ৩৫৩। এ ৩৫৩টি স্টেশনে আবার ব্যবহার করা হচ্ছে পাঁচ ধরনের সিগন্যাল ব্যবস্থা। এর মধ্যে সর্বাধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থাটি হচ্ছে রিলে ইন্টারলকিং সিগন্যালিং। ব্যবস্থাটি পুরোপুরি কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত। সাধারণত যেসব স্টেশনে ট্রেন চলাচল বেশি, সেসব স্টেশনে এ সিগন্যাল ব্যবস্থা রাখা হয়। রেলওয়েতে এ ধরনের সিগন্যাল ব্যবস্থাসম্পন্ন স্টেশনের সংখ্যা ২২, যার ২০টিই রয়েছে পূর্বাঞ্চলে। অন্যদিকে কম্পিউটার বেজড ইন্টারলকিং সিস্টেম (সিবিআই) ব্যবস্থা আছে ১১২টি স্টেশনে। রেলওয়ে প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, এ দুটি সিগন্যাল ব্যবস্থাকে আধুনিক বলা যায়। বাকি ২১৯টি স্টেশনের সিগন্যাল ব্যবস্থা বেশ পুরনো।

এ পুরনো পদ্ধতিগুলোর একটি হলো মেকানিক্যাল ইন্টারলকড সিগন্যাল ব্যবস্থা। লাইনের পাশে এক ধরনের তার ব্যবহার করা হয় এ ধরনের সিগন্যালের জন্য, যা সংযুক্ত থাকে স্টেশন এলাকায় স্থাপিত লিভারের সঙ্গে। এ লিভারে টান দিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের ৭২টি স্টেশনের সিগন্যাল নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।

লাল-সবুজ বাতি ব্যবহার করে ট্রেনের সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ করা হয় দেশের ১২২টি স্টেশনে। এ ব্যবস্থাকে বলা হয় নন-ইন্টারলকড কালার লাইট সিগন্যালিং। ২৫টি স্টেশনে আবার এ ব্যবস্থাও নেই। এসব স্টেশনে ট্রেন প্রবেশের আগ মুহূর্তে স্টেশনমাস্টার ঠিক করেন, কোন লাইন দিয়ে ট্রেনটি যাবে। সে অনুযায়ী দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীরা ট্রেন যাওয়ার লাইনটি ঠিক করে দেন। এ পদ্ধতিকে বলা হয় নন-ইন্টারলকড মেকানিক্যাল সিগন্যালিং সিস্টেম।

বাংলাদেশ রেলওয়ের ২০১৯ সালের ইনফরমেশন বুকের হিসাব অনুযায়ী, এখনো ১৩০টি স্টেশন সিগন্যালিং সুবিধার বাইরে রয়েছে। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে রেলওয়ের প্রধান সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী বেনু রঞ্জন সরকার বণিক বার্তাকে বলেন, রেলওয়ের আইন অনুযায়ী ‘ডি’ ক্যাটাগরির স্টেশনে সিগন্যাল ব্যবস্থার প্রয়োজন হয় না। সিগন্যাল সিস্টেম না থাকা স্টেশনগুলো এই ক্যাটাগরিতেই পড়েছে।

রেলওয়ের হিসাব বলছে, ৪৮৩টি স্টেশনের মধ্যে আধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থা আছে মাত্র ১৩৪টিতে। বাকিগুলোয় ভিন্ন ভিন্ন পুরনো ব্যবস্থায় ট্রেন পরিচালনা করা হচ্ছে। রেলওয়েতে সিগন্যালিং ব্যবস্থার আধুনিকায়নের বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, ‘উন্নত বিশ্বে ট্রেনের সিগন্যাল ব্যবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। প্রযুক্তি এসে জটিল এ কাজ সহজ করে দিয়েছে। পাশাপাশি আধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থা সেসব দেশে ট্রেন পরিচালনাকেও সহজ করে দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে ঘটছে উল্টোটি। এখানে কোনো ধরনের পরিকল্পনা ছাড়াই নামানো হয় একের পর এক ট্রেন। কিন্তু এ ট্রেনগুলো সুশৃঙ্খল ও ঝুঁকিমুক্তভাবে চলাচলের জন্য যে সিগন্যাল ব্যবস্থা দরকার, সেদিকে নজর দেয়া হচ্ছে না। এখানে উন্নয়নটা হচ্ছে বড় বড় প্রকল্পকেন্দ্রিক। যেসব উন্নয়নে ব্যাপক দুর্নীতির সুযোগ রয়েছে সেসব উন্নয়নকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছি আমরা। সিগন্যাল ব্যবস্থার আধুনিকায়ন না করে একের পর এক ট্রেন নামাচ্ছি, যার খেসারত দিতে হচ্ছে একের পর এক দুর্ঘটনার মাধ্যমে।’

তবে রেলওয়ে কর্মকর্তারা বলছেন, সিগন্যাল ব্যবস্থা আধুনিকায়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তারা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে ১৩৪টি স্টেশনকে আধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থার আওতায় এনেছি। পর্যায়ক্রমে দেশের সব স্টেশনেই আধুনিক ও অভিন্ন সিগন্যাল ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। যেসব নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে, সেগুলোকে আধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থায় আনা হচ্ছে।’ তবে কাজটির পরিধি অনেক বেশি উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশের সব স্টেশন আধুনিক ও অভিন্ন সিগন্যাল ব্যবস্থায় আনতে কিছুদিন সময় লাগবে।

সূত্র:বণিক বার্তা, মার্চ ২১, ২০২১


About the Author

RailNewsBD
রেল নিউজ বিডি (Rail News BD) বাংলাদেশের রেলের উপর একটি তথ্য ও সংবাদ ভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল।

Comments are closed.