শিরোনাম

রেলে প্রস্তুত করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর

ছবিঃ সংগৃহীত

।। নিউজ ডেস্ক ।।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুকে সম্মান জানাতেই দেশের প্রথম ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর ‘বঙ্গবন্ধু ভ্রাম্যমাণ রেল জাদুঘর’ প্রস্তুত করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এখন অপেক্ষা শুধু উদ্বোধনের। একটি মিটারগেজ ও একটি ব্রডগেজ রেলকোচের ভেতরে প্রস্তুত করা হয়েছে এই ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর। দেশের বিস্তীর্ণ রেল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবন, জীবনাদর্শ, জাতির জন্য তার অনন্য ত্যাগ ও অবদানকে শহর থেকে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দেওয়া এবং নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতেই ব্যতিক্রমী এ উদ্যোগ। বিভিন্ন ছবি, প্রতিকৃতি, ভিডিওসহ ডিজিটাল শিল্পকর্মের মাধ্যমে জাদুঘরটি সাজানো হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ওপর ভিত্তি করে তার কর্মজীবনকে মোট ১২টি ভাগে ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে জাদুঘরে। জাদুঘরের প্রবেশপথ থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত রাখা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর জীবনালেখ্য।

কোচের একপাশের দেয়ালের ছয়টি ভাগে রয়েছে—কিংবদন্তির প্রথম প্রহর, ধ্রুবতারার প্রথম কিরণ, নক্ষত্র হওয়ার পথে, বাংলার মাটি ও ভাষার বঙ্গবন্ধু, ধূমকেতু থেকে নক্ষত্র, মুক্তির স্বপ্নের সূচনা শিরোনামে বঙ্গবন্ধুর জীবনচরিত। এখানে তুলে ধরা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর শৈশব থেকে পর্যায়ক্রমে তার ছাত্রজীবন, রাজনীতির হাতেখড়ি, মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করার মাধ্যমে গণমানুষের প্রাণের নেতা হয়ে ওঠা, ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অবর্ণনীয় নির্যাতন, ৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট, মিথ্যা মামলা ও কারাভোগ, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামের ইতিহাস।

অপর পাশের দেয়ালের ছয়টি ভাগে রয়েছে—দুর্বার পথচলা, নিপীড়িতের কাণ্ডারি, এক নতুন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন, মুক্তি, সংগ্রাম আর স্বাধীনতার কথা, স্বপ্নগড়ার দিনগুলো, যে আলো নেভেনি আজও এমন শিরোনামে শিল্প প্রদর্শনী। এতে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ৬৬-এর ঐতিহাসিক ছয় দফা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও জাতির গৌরবোজ্জ্বল ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জনের প্রধান নায়ক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর অবদানের তথ্যচিত্র। আলোকোজ্জ্বল, মনোমুগ্ধকর ও আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে চমৎকারভাবে বঙ্গবন্ধুকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে জাদুঘরটিতে।

জাদুঘরে কমলাপুর রেলস্টেশনের সামনে বিজয় স্তম্ভ ৭১-এর অবিকল রেপ্লিকাসহ ১৩টি টেবিলে রাখা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর জীবনালেখ্য। এতে বঙ্গবন্ধুর আদি পৈত্রিক বাড়ি, ব্যবহৃত চশমা, দলের প্রতীক নৌকা, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, বঙ্গবন্ধুর প্রিয় তামাক পাইপ আর প্রিয় মুজিব কোট। এছাড়া মুজিব শতবর্ষের লোগো, বঙ্গবন্ধুর লেখা বই, মুজিবনগর স্মৃতিস্তম্ভ, পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধের রেপ্লিকা রয়েছে সেখানে। দেয়ালজুড়ে টাঙানো হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত ও রাজনীতিক জীবনের ২৪টি দুর্লভ ছবি।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দিতে এ জাদুঘর সম্বলিত কোচের এক প্রান্তে রাখা হয়েছে একটি কেন্দ্রীয় এলইডি মনিটর। যেখানে বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা গানের ওপর জাদুঘরের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে একটি মনোমুগ্ধকর থিম সং। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ও ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে বাংলায় দেওয়া ভাষণ দেখা যাবে ও শোনা যাবে চারটি সাউন্ড বক্সের মাধ্যমে।

শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের দেয়ালজুড়ে রয়েছে ১২টি এলইডি মনিটর, যার প্রতিটিতে সমৃদ্ধ ভিডিও ও স্থিরচিত্রের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর জীবনালেখ্য তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে শিমুল মোস্তফার কণ্ঠে প্রতিটি ভাগে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলো উপস্থাপন করা হয়েছে। চাইলেই হেডফোন ব্যবহার করে প্রতিটি পর্বের বর্ণনা শুনতে পারবেন দর্শনার্থীরা। তবে মিটারগেজ রেলকোচ ছোট হওয়ায় এতে ছোট এলইডি রাখা হয়েছে ১০টি। আর অবিকল রেপ্লিকার জন্য টেবিল রাখা হয়েছে ১২টি। বাকি সব ব্রডগেজ রেলকোচের মতো একই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে মিটারগেজ কোচটিতে।

অগ্নিনির্বাপণের জন্য ভ্রাম্যমাণ এই জাদুঘরে রয়েছে দুটি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র। ভেতরের নিরাপত্তার জন্য দুটি সিসি ক্যামেরা রাখা হয়েছে। সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সংযোগ ঠিক রাখতে রাখা হয়েছে আইপিএস সুবিধাও। কোচটি বিভিন্ন স্টেশনে গেলে সেখানে যাতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া যায় সেজন্য কোচ বা বগির বাইরের অংশে বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থাও থাকবে।

জানতে চাইলে জাদুঘর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইভেন্ট কমের অপারেশন ম্যানেজার মো. আরাফাত হোসেন বলেন, চলতি বছর মার্চে করোনার সময় আমরা কাজটা পেয়েছি। আমাদের অনেকগুলো টিম কাজ করেছে। সবগুলো উন্নত টেকনোলোজি ব্যবহার করেছি। যেহেতু এটি বাইরে থাকবে তাই বজ্রপাত থেকে রক্ষার জন্য সেন্সর ব্যবহার করা হয়েছে। যেটাতে বজ্রপাত ডিটেক্ট করবে। চাইলেই ইন্টারনেট বা ওয়াইফাই সংযোগ করা যাবে এখানে। ১২টি ভাগ করে প্রতিটিতে একটি এলইডি মনিটর স্থাপনসহ দুটি স্থিরচিত্র রাখা হয়েছে। হেডফোনও রাখা হয়েছে, যা দিয়ে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে শুনতে পারবে দর্শনার্থীরা।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাঙালি জাতির কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার স্বাদ ও নতুন বাংলাদেশের নানা চিত্র তুলে ধরা হয়েছে জাদুঘরটিতে। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশ বিনির্মাণসহ চিত্রিত হয়েছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের বাঙালির ইতিহাসের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ।

শীততাপ নিয়ন্ত্রিত জাদুঘরটিতে রয়েছে জয় বাংলা স্লোগানের আদলে তৈরি করা সৃজনশীল একটি বুক শেল্ফ। যেখানে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘আমার দেখা নয়া চীনসহ তার কর্মজীবনের ওপর রচিত গুরুত্বপূর্ণ বই। রয়েছে বঙ্গবন্ধুকে শেখ হাসিনার লেখা বই ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’। ‘জয় বাংলা’ বুক শেল্ফে ৮০-১০০টি বইয়ের মধ্যে রয়েছে শিশুদের জন্য বঙ্গবন্ধুর ওপর রচিত বিভিন্ন শিশুতোষ বই। ‘যাদু মনি’ সম্বোধন করে মেয়ে হাসুকে লেখা বঙ্গবন্ধুর চিঠিসহ তিনটি করে মোট ছয়টি চিঠি রয়েছে এখানে, যা বঙ্গবন্ধুকে আরও গভীরভাবে বুঝতে সাহায্য করবে দর্শনার্থীদের।

জাদুঘরটি দৃষ্টিনন্দন আলোকসজ্জা ও ইন্টেরিয়র ডিজাইনের মাধ্যমে সাজানো হয়েছে। দর্শকের নজর কাড়তে ভেতরেই তৈরি করা হয়েছে কৃত্রিম ফুলের বাগান। এছাড়া ভ্রাম্যমাণ জাদুঘরের বহিরাবরণ সজ্জিত হয়েছে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ধারাবাহিক সংগ্রামের ওপর শিল্পীর আঁকা রঙিন ম্যুরাল চিত্রের মাধ্যমে।

সময় বহমান হলেও কালের সাক্ষী হওয়া ঐতিহাসিক নিদর্শন বা স্থাপনাগুলো একটি জাতির অর্জনগুলো তুলে ধরে নতুন প্রজন্মের সামনে। এই রেল জাদুঘর নিয়ে এমনই কর্মপরিকল্পনা রয়েছে কর্তৃপক্ষের। বাংলাদেশ রেলওয়ের ৮০ শতাংশ স্টেশন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে।

সহজেই বিস্তৃত রেল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ভ্রাম্যমাণ জাদুঘরটি যেতে পারবে সবখানে। নির্ধারিত স্টেশনে দু-তিনদিন রেখে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা থাকবে। জাদুঘরটি কোনো স্টেশনে যাওয়ার আগে ওই এলাকায় এ নিয়ে চলবে প্রচারণা। যার মাধ্যমে গ্রামীণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাবে জাতির জনকের ইতিহাস। বছরভিত্তিক কর্মপরিকল্পনায় তা বাস্তবায়িত হবে দেশজুড়ে। দেশের প্রান্তিক মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ পৌঁছে দেওয়াই এ জাদুঘর বানানোর অন্যতম উদ্দেশ্য।

ব্যতিক্রমী এ উদ্যোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব সেলিম রেজা জাগো নিউজকে বলেন, ‘মুজিববর্ষে আমরা নতুন কিছু করার কথা ভাবছিলাম। সেই ভাবনা থেকেই এটা করা। সারাদেশের বেশিরভাগ রেল স্টেশন উপজেলা পর্যায়ে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানানোর জন্য এ উদ্যোগ। এজন্য ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর বানানো হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে এটি ছড়িয়ে যাবে সব জায়গায়। যখন যেখানে যাবে সেখানে আগে থেকে প্রচার করা হবে। টিম করে দেওয়া হবে। নিরাপত্তা ব্যবস্থাও রাখা হবে। আমরা এটার ধারাবাহিতা অক্ষুণ্ণ রাখতে চাই। স্কুল পর্যায় পর্যন্ত এটা পৌঁছাবে বলে আশা করছি।’

কবে নাগাদ এ ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর চালু হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগামী ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বা বিজয় দিবসের আগে এটা উদ্বোধনের সম্ভাবনা রয়েছে। এরই মধ্যে আমরা প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টি জানিয়েছি। তিনি যখন সময় দেবেন তখনই এর উদ্বোধন করা হবে।’

সূত্রঃ জাগোনিউজ২৪


About the Author

RailNewsBD
রেল নিউজ বিডি (Rail News BD) বাংলাদেশের রেলের উপর একটি তথ্য ও সংবাদ ভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল।

Comments are closed.