শিরোনাম

বেঁচে যাওয়া ১৩০০ কোটি টাকা ফেরত দেবে না রেলওয়ে


শামীম রাহমান : দ্বিতীয় কাঁচপুর, দ্বিতীয় মেঘনা ও দ্বিতীয় মেঘনা-গোমতী সেতু নির্মাণের দায়িত্ব পেয়েছিল তিনটি জাপানি প্রতিষ্ঠান। নির্ধারিত সময়ের আগে কাজ করে এসব প্রকল্প থেকে বেঁচে যাওয়া ৭৩৮ কোটি টাকা ২০১৯ সালে সরকারকে ফেরত দিয়ে যায় তারা। নিয়ম অনুযায়ী, প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পরও যদি সংস্থান হওয়া অর্থ শেষ না হয়, তবে তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ফেরত দিতে হবে। তবে সম্প্রতি এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানোর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (ইআইবি) কাছ থেকে ঋণ নিয়ে আখাউড়া-লাকসাম রেলপথ নির্মাণ করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য যে পরিমাণ টাকার সংস্থান ছিল, তার চেয়ে কমে ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তি করে সংস্থাটি। এতে সাশ্রয় হয় ১ হাজার ৩০১ কোটি টাকা। তবে বাংলাদেশ রেলওয়ে এ টাকা ‘সারেন্ডার’ না করে বা ফেরত না দিয়ে প্রকল্পেই খরচ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এজন্য বিদ্যমান কাজগুলোর পরিধি বৃদ্ধি, নতুন অনুষঙ্গ তৈরি ও পরামর্শক ব্যয় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থাটি।

রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, মাটির কাজের পরিমাণ বৃদ্ধি, সয়েল ট্রিটমেন্ট, আখাউড়ায় খাদ্যগুদাম স্থানান্তর ও নির্মাণ, করোনা মহামারীর প্রভাব, প্রলম্বিত বর্ষার প্রভাবসহ বিভিন্ন কারণে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন বিলম্বিত হচ্ছে। এসব কারণে প্রকল্পের নির্মাণ প্যাকেজ ও পরামর্শক ব্যয় বাড়ছে। ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সাশ্রয় হওয়া টাকা প্রকল্পেই খরচ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেলওয়ে।

আখাউড়া-লাকসাম রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে নির্মাণকাজ ও পরামর্শক কাজের দুটি প্যাকেজে অর্থ সাশ্রয় হয়েছে। ৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ দুটি সমান্তরাল ডুয়াল গেজ রেলপথ নির্মাণের জন্য ৪ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা প্রাক্কলিত মূল্যে দরপত্র আহ্বান করেছিল রেলওয়ে। এ কাজ বাস্তবায়নের জন্য দেশী-বিদেশী মিলিয়ে ২৬টি প্রতিষ্ঠান দরপত্র কিনলেও দাখিল করে মাত্র চারটি প্রতিষ্ঠান। সবচেয়ে কম দর প্রস্তাব করে চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি), বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন ও ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের জয়েন্ট ভেঞ্চার বা সম্মিলিত উদ্যোগ। ৪ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকার কাজটি এ তিন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নেয় ৩ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকায়। ফলে এ কাজে রেলওয়ের সাশ্রয় হয় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার বেশি।

একইভাবে প্রকল্পের পরামর্শক কাজের জন্য ২৫৮ কোটি টাকা প্রাক্কলিত মূল্যে দরপত্র আহ্বান করে রেলওয়ে। সর্বনিম্ন দর প্রস্তাব করে কাজটি পেয়ে যায় কোরিয়ার দোহা ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড, কোরিয়া রেল নেটওয়ার্ক অথরিটি, জাপানের ওরিয়েন্টাল কনসালট্যান্টস গ্লোবাল কোম্পানি লিমিটেড, ভারতের বেলাজি রেল রোড সিস্টেমস লিমিটেড ও বাংলাদেশের ডেভেলপমেন্ট ডিজাইন কনসালট্যান্ট লিমিটেডের জয়েন্ট ভেঞ্চার। তাদের সঙ্গে পরামর্শক কাজের জন্য ২৩১ কোটি ৩৭ লাখ টাকার চুক্তি করে রেলওয়ে। প্রাক্কলিত দরের চেয়ে চুক্তিমূল্য কম হওয়ায় সব মিলিয়ে এ দুই কাজে ১৫৩ দশমিক ১৬ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হয়, টাকার অংকে যা ১ হাজার ৩০০ কোটির বেশি।

সাশ্রয় হওয়া টাকার বড় অংশ এডিবির অর্ডিনারি ক্যাপিটাল রিসোর্সেসের (ওসিআর)। এডিবির সঙ্গে করা ঋণচুক্তি অনুযায়ী, অর্থ ফেরত দিতে হলে দশমিক কমিটমেন্ট চার্জ দিতে হবে রেলওয়েকে। এমন অবস্থায় সাশ্রয় হওয়া টাকার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গত জানুয়ারিতে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের মতামত জানতে চেয়ে চিঠি দেয় সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। পরে বাংলাদেশ রেলওয়ে জানিয়ে দেয়, তারা সাশ্রয় হওয়া টাকা ‘সারেন্ডার’ করবে না।

সাশ্রয় হওয়া টাকার বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে গত বৃহস্পতিবার রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের সভাপতিত্বে রেলভবনে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বেঁচে যাওয়া ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা একই প্রকল্পে খরচের সিদ্ধান্ত হয়। প্রকল্পের ভূমি উন্নয়নকাজে অতিরিক্ত ৩৪০ কোটি টাকা, সেতু ও কালভার্টের কাজে ৯০ কোটি ৩৯ লাখ, স্টেশন বিল্ডিং নির্মাণকাজে ২২১ কোটি, রেলওয়ে ট্র্যাকের কাজে সাড়ে ১৬ কোটি, আনুষঙ্গিক কাজে ৭২ কোটি, সিগন্যালিং কাজে ৯১ কোটি ৮৩ লাখ, জেনারেল রিক্রুটমেন্ট কাজে ৩৬ কোটি ২৯ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয়ের সিদ্ধান্ত হয় ওই সভায়। অন্যদিকে পরামর্শক কাজের ব্যয় বাড়ানো হয় ১৬৭ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। এর বাইরে ফিজিক্যাল কন্টিনজেন্সি খাতে ৩৭ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ও প্রাইস কন্টিনজেন্সি খাতে ২২৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা ব্যয় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়।

গতকাল এ বিষয়ে জানতে চাইলে আখাউড়া-লাকসাম প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শহীদুল ইসলাম কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। পরে যোগাযোগ করা হয় বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক ডিএন মজুমদারের সঙ্গে, যিনি এক সময় একই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বও পালন করেছেন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, প্রকল্পটি শুরুর পর থেকে এখনো সংশোধন হয়নি। কিন্তু এরই মধ্যে মাটির কাজের পরিমাণ বেড়েছে, নিম্নমানের মাটির কারণে খরচ বেড়েছে, খাদ্যগুদাম স্থানান্তরের প্রয়োজন হয়েছে, যেগুলো ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) ছিল না। পাশাপাশি কভিড পরিস্থিতির কারণেও বাস্তবায়ন কাজ বিলম্বিত হচ্ছে। এসব কারণে স্বাভাবিকভাবেই প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যেত। তাই আমরা সাশ্রয় হওয়া টাকাটা সারেন্ডার করিনি। একবার সারেন্ডার করে ফেললে সেই টাকা তো আর আমরা ফেরত পেতাম না। প্রকল্পের ডিপিপি সংশোধনের কাজ চলছে। সংশোধন করে সাশ্রয় হওয়া টাকাগুলো সমন্বয় করার কথা জানান বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক।

আখাউড়া-লাকসাম ডাবল লাইন রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের অংশ। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ৭২ কিলোমিটারের ডুয়াল গেজ ডাবল লাইন রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। ৩২১ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের ২৪৯ কিলোমিটার অংশ এরই মধ্যে ডাবল লাইনে উন্নীত করা হয়েছে। আখাউড়া-লাকসামের কাজটি শেষ হলেই ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত পুরো রেলপথটি ডাবল লাইনের আওতায় চলে আসবে। ২০১৬ সালে শুরু হয়েছে, এখন পর্যন্ত প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৭৪ শতাংশ। সব মিলিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। আগামী জুন পর্যন্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মেয়াদ। তবে ধীরগতির কারণে প্রকল্পটির নির্মাণকাল আরো বৃদ্ধি পাবে বলে জানিয়েছেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা।

সূত্র:বণিক বার্তা, মে ২৩, ২০২১


About the Author

RailNewsBD
রেল নিউজ বিডি (Rail News BD) বাংলাদেশের রেলের উপর একটি তথ্য ও সংবাদ ভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল।

Comments are closed.