শিরোনাম

ওয়েম্যান-গেটম্যান-ট্রলিম্যান: থাকার কথা রেলপথে, কাজ করছেন অফিস-বাসায়!

ওয়েম্যান-গেটম্যান-ট্রলিম্যান: থাকার কথা রেলপথে, কাজ করছেন অফিস-বাসায়!

শিপন হাবীব:
রেলের উন্নয়নে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে ব্যাপক আগ্রহ-বিনিয়োগ থাকলেও রেলের কর্মকর্তা পর্যায়ে তার উল্টো চিত্রই পরিলক্ষিত হচ্ছে। যে কারণে রেলের উন্নয়নে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হলেও রেলপথ অরক্ষিতই থেকে যাচ্ছে। রেলপথ নিয়ে চরম অবহেলা তো আছেই।

ফলে ছোটখাটো লাইনচ্যুতি, দুর্ঘটনা, রেল চলাচল সাময়িক স্থগিত লেগেই আছে। গবেষণায় দেখা গেছে, দুর্ঘটনার ৮০ ভাগই ঘটছে সংস্কারহীন রেলপথের জন্য। সূত্র বলছে, রেলপথ সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত ওয়েম্যান-গেটম্যান-ট্রলিম্যান-গ্যাংম্যানদের অনেকেই কাজ করছেন অফিসে, বসদের বাসায়। ফলে আরও অরক্ষিত হয়ে পড়ছে রেলপথ।

এমনিতেই এ ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির পদে ১৪ হাজার ৭৩২টি পদ খালি। রেলপথের নাট-বল্টু, হুক-ক্লিপ, পাথর উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রায়শই ঘটছে। যেখানে রেলপথ তদারকির জন্য বিভিন্ন বিভাগ থেকে আরও লোক নিয়োজিত করার কথা এ খাতে, সেখানে কর্মকর্তারা উল্টো ওয়েম্যান ও ট্রলিম্যানদের অফিস-বাসার কাজে ব্যস্ত রাখছেন।

কথা হয় রেলপথ সচিব মোফাজ্জেল হোসেনের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, রেলপথকে সর্বোচ্চ নিরাপদ করতে যখন আমরা তৎপর তখন এমন সংবাদ খুবই দুঃখজনক। মাঠপর্যায় তথা রেলপথের কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোনো অবস্থাতেই মাঠপর্যায়ের কর্মীরা কর্মকর্তাদের বাসায় কাজ করতে পারেন না। এ নিয়ে সংসদীয় কমিটিতেও আলোচনা হয়েছে। তারা উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন।

পরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তারা ওয়াদা করেছিলেন, তারা কেউই আর অফিসে বা বাসায় তাদের দিয়ে কাজ করাবেন না। এরপরও মাঠে কাজ না করে অফিস বা বাসায় যারা কাজ করছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জরাজীর্ণ ও মেরামতহীন রেলপথের কারণে যখন পরপর বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে, তখনও মাঠপর্যায়ের ৩১ কর্মচারী বছরের পর বছর রেলপথ মন্ত্রণালয়ে কাজ করছেন। ২০১৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রেলভবনে মাসিক পর্যালোচনা সভার কার্যবিবরণী সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩১ জন ওয়েম্যান, গেটম্যান ও ট্রলিম্যানকে নিজ কর্মস্থলে ফেরার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।

তৎকালীন রেলওয়ের মহাপরিচালক আমজাদ হোসেনের ওই নির্দেশনার পর আজও তারা বহাল তবিয়তে আছেন। ১০ জুলাই পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলীর কাছে ঢাকা রেলওয়ে বিভাগীয় সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী-১ আবু রাফি মোহাম্মদ ইমতিয়াজ হোছাইন একটি চিঠি দেন। সেখানেও রেললাইন মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে কর্মচারীদের জরুরি প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে।

চিঠিতে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা-টঙ্গী সেকশনে ওয়েম্যান সংকটের কারণে রেললাইনের জরুরি রক্ষণাবেক্ষণ সঠিকভাবে হচ্ছে না বলেও বলা হয়েছে। এত কিছুর পরও ৩১ জন কর্মচারী রেলপথ মন্ত্রণালয়ে আছেন বীরদর্পেই। জানা গেছে, এদের দিয়ে কর্মকর্তারা তাদের বাসাবাড়ির কাজও করাচ্ছেন। মন্ত্রণালয় ও রেলভবনে ওয়েম্যানদের মধ্যে আছেন- জালাল উদ্দিন, মাফুজ মিয়া, জসীম উদ্দিন, জাকির হোসেন, তাসলিমা আক্তার, মহিউদ্দিন, ইকবাল হোসেন, তৃনা আহম্মেদ, সৈয়দ আলী আকবর, ফেরদৌসি বেগম, মানিক মিয়াম রোমেল খান, ফিরোজ আহম্মেদ, জান্নাতুল নাহার, আয়শা ফেরদৌসী শিল্পি, আনিসুল হক ভূক্রা, সোহেল রানা, সোহেল মিয়া, মফিজ মিয়া, মিলন হোসেন, ছলেমান সিকদার, আলী হোসেন, মো. মানিক মিয়া ও আইনুল হক বিভিন্ন অফিসে কাজ করছেন। ট্রলিম্যানদের মধ্যে রেলভবনে আছেন- শফিকুল ইসলাম, আনোয়ার হোসেন, মোহাম্মদ খোকন ও মাহবুব আলম।

গেটকিপারদের মধ্যে রেলভবনে আছেন- আবদুল মতিন, আলমগীর হোসেন ও লুৎফুর রহমান। রেলওয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, মাঠপর্যায়ের এ কর্মচারীরা রেলভবনে অলস সময় কাটান। রাজনৈতিক প্রভাব থাকায় অফিসারদেরও মান্য করতে চান না বলে অভিযোগ রয়েছে।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবু জাফর মিয়া যুগান্তরকে জানান, পশ্চিমাঞ্চলে রেলপথের বেশ কিছু কর্মচারী বিভিন্ন অফিস ও অফিসারদের বাসায় কাজ করতেন।

এখন আর নেই, তারা নিজ নিজ কাজে ফিরেছেন। আমার প্রকৌশল দফতরে মাঠপর্যায়ের কর্মীরা মাঠেই আছেন। বাকি দফতরগুলোর কথা আমি বলতে পারছি না। তবে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে এখনও অনেক ওয়েম্যান, গেটম্যান, ট্রলিম্যান অফিসারদের বাসার কাজে নিয়োজিত। একজন কর্মকর্তা বলেছেন, রেলে লোকবলের ঘাটতি আছে এটা ঠিক, তবে যে লোকবল আছে তার যথাযথ ব্যবহারও হচ্ছে না।

আন্তরিকতার ঘাটতি যেমন আছে, আছে দায়িত্বে অবহেলাও। যার কারণে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হলেও ঘটছে ঘন ঘন লইনচ্যুতি, দুর্ঘটনা।

বর্তমান সরকার গত ১১ বছরে রেলের উন্নয়নে প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে। লোকবল নিয়োগ দেয়া হয়েছে ১৩ হাজার। এরপরও দুর্ঘটনা কমছে না। রেলপথ কর্মীরা যেমন মন্ত্রণালয়ের অফিসারদের অফিস-বাসায় কাজ করছে, ঠিক তেমনি কর্মচারীদের বড় অংশই কাজে ফাঁকি দিচ্ছে। যার খেসারত দিচ্ছেন যাত্রীরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাকরি পাওয়ার পর অনেক পরিচ্ছন্নতা কর্মীকে তাদের কাজে হরিজন সম্প্রদায়ের লোকদের ভাড়ায় খাটাতে দেখা গেছে। অনেকে আবার নামকাওয়াস্তে হাজিরা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করছেন। আগে ক্লিনার পদে হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজন চাকরি পেলেও এখন নানা কায়দায় ঢুকে পড়ছেন নন-হরিজনরাও। এখানেও রয়েছে দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ।

রেলের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, এমন অনৈতিক কাজ বছরের পর বছর ধরে চলছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার যেন কেউ নেই। রেলের অব্যবস্থাপনা, রক্ষণাবেক্ষণে গাফিলতি ও অনিয়মের নানা চিত্র দুদকের প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে।

কথা হয় বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হকের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে জানান, রেলপথ নির্মাণের দিন থেকেই রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে তা একই মানের রাখতে হবে। প্রতিটি নাটবল্টু, পাত, ফিশপ্লেট, ক্লিপ-হুক যথাযথ অবস্থানে থাকতে হয়। উনিশ-বিশ হলেই ভয়ানক। যার কারণে ঘন ঘন ট্রেন লাইনচ্যুতি, দুর্ঘটনা ঘটছে। এর পেছনে অবশ্যই রক্ষণাবেক্ষণে গাফিলতি রয়েছে। চাকরি পেয়েছেন ওয়েম্যান, গেটম্যান ও ট্রলিম্যান পদে, অথচ কাজ করছেন অফিসে-কর্মকর্তাদের বাসায়। এসব কারণে রেলপথ ভয়ংকর হয়ে উঠছে। মাঠপর্যায়ে কর্মীদের উপস্থিতি, তদারকি নিশ্চিত করতে না পারলে রেলপথ আরও ভয়ংকর হয়ে উঠবে।

সুত্র:যুগান্তর, ২৭ জুলাই ২০১৯


About the Author

RailNewsBD
রেল নিউজ বিডি (Rail News BD) বাংলাদেশের রেলের উপর একটি তথ্য ও সংবাদ ভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল।

Comments are closed.