শিরোনাম

অবহেলায় ১৩৭ বছর

অবহেলায় ১৩৭ বছর

শিপন হাবীব :

‘নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা’ রেলপথ ছিল রেল ইতিহাসে অন্যতম। স্থাপিত হয়েছিল ১৮৮৫ সালের ৪ জানুয়ারি। ১৪.৯৮ কিলোমিটার ওই পথই ছিল রেলের স্বর্ণযুগ। কিন্তু রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও দায়িত্বহীনতায় ঐতিহ্যের এ রেলপথ এখন রূপকথায় পরিণত হয়েছে। প্রায় ১৩৭ বছর আগে এ পথটি উদ্বোধন হলেও যুগে যুগে শুধু ধ্বংসই হয়েছে। শুরুতে লাইন, স্টেশনে আধুনিকতা আর ঐতিহ্যের ছোঁয়া থাকলেও এখন তলানিতে ঠেকেছে। নামমাত্র ট্রেন চলছে-সেবা নেই বললেই চলে। চরম অব্যবস্থাপনার মধ্যে চালানোর কারণে একটু উনিশ-বিশ হলেই ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটছে। মারা যাচ্ছে যাত্রী ও পথচারী। স্বাধীনতার পর থেকে রেলসেবা কমতে থাকে। চলমান রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বাড়তে থাকে ঝুঁকি। বর্তমান সরকারের এক যুগে রেল উন্নয়নে আমূল পরিবর্তন এলেও এ পথে এখনো উন্নয়ন প্রকল্প শেষ হয়নি।

স্বাধীনতার পরও এ পথে উন্নত সেবা আর নিরাপত্তা নিয়ে ট্রেন চলাচল করছিল। ৮০ দশকের পর থেকেই হারাতে থাকে এর ঐতিহ্য। ক্ষয় হতে থাকে লাইন, বিলুপ্ত হতে থাকে লাইনের যন্ত্রাংশ। জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে স্টেশনগুলো। এ পথে রেলের সবচেয়ে জরাজীর্ণ ট্রেনগুলো ব্যবহৃত হয়ে আসছে। গত কয়েক বছর এ পথে ‘ডেমু’ ট্রেন চালানো হচ্ছে। ডেমুকে ইতোমধ্যে খোদ রেলওয়ে কর্মকর্তারাই ‘গলার কাঁটা’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। নেই টয়লেটের কোনো ব্যবস্থা। একদিন চললে দুদিন নষ্ট থাকে। অথচ অল্প দূরত্বের এ রেলপথেই সবচেয়ে বেশি যাত্রী চলাচল করে। চাহিদা রয়েছে বর্তমানে যে পরিমাণ যাত্রী চলাচল করে তার চেয়ে প্রায় ১০০ গুণ বেশি। এ হিসাব রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের। বর্তমানে মৃতপ্রায় লাইন দিয়ে ১৭ ঘণ্টায় ২৬ জোড়া ট্রেন চলে। চলমান লাইন সংস্কার এবং ২য় ও ৩য় লাইন স্থাপন হলে উল্লেখিত সময়ে প্রায় ৯০ জোড়া ট্রেন চালানো সম্ভব হবে।

নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা রেললাইনটি স্থাপনের কয়েক বছর পর ঢাকা-ময়মনসিংহ এবং ১৮৯৪ সালে ময়মনসিংহ-জামালপুর, ১৯১২ সালে জামালপুর-বাহাদুরাবাদ পর্যন্ত রেলপথ স্থাপিত হয়। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথের উন্নয়ন না হলেও বাকি রেলপথে উন্নয়ন হয়েছে। একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণও করা হয়েছে। ক্ষোভ প্রকাশ করে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথে চলা যাত্রী আব্দুল রসুল জানান, ব্রিটিশ আমল থেকেই যাত্রী ও মালামাল আনা-নেওয়ায় অন্যতম ছিল এ রেলপথ। স্বাধীনতার পর থেকেই এ পথ রূপ হারাতে থাকে। এজন্য দায়ী খোদ রেলওয়ে কর্মকর্তারা। বড় প্রকল্প মানেই বড় দুর্নীতি-অনিয়ম। কম দূরত্বের এ পথে কোনো কর্মকর্তাই নজর দেননি।

রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, ২০১৫ সালের ২০ জানুয়ারি ‘ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সেকশনে বিদ্যমান মিটারগেজ রেললাইনের সমান্তরাল একটি ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণ’ প্রকল্প অনুমোদন করে একনেক (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি)। প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৭৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। প্রকল্পে প্রায় ৭ বছরে ৭০ শতাংশ কাজ হয়েছে। ২০১৭ সালের জুনে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ে প্রকৌশলী দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, এ পথে ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন নির্মাণ ছাড়া প্রকৃতপক্ষে যাত্রীসেবার সঙ্গে মালামাল পরিবহণ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। জরাজীর্ণ চলমান মিটারগেজ লাইনের পাশে শুধু ডুয়েল গেজ লাইন স্থাপনের মধ্য দিয়ে কাঙ্ক্ষিত ফল আসবে না। রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, গুরুত্বপূর্ণ এ রেলপথকে ডুয়েল গেজ ডাবল লাইনে উন্নত করতে ১৮৮২ সালেই চলমান লাইনের দুপাশে ৬২ ফুট প্রস্থ জমি অধিগ্রহণ করেছিল তৎকালীন ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে। স্বাধীনতার পর থেকেই লাইনের দুপাশ দখল করে নেয় ভূমিদস্যুরা। বিভিন্ন সময় লোক দেখানো উচ্ছেদ হলেও কিছুদিন পরেই আবার উদ্ধারকৃত জায়গা বেদখল হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-রাজশাহী, ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথে মিটার গেজ, ডুয়েল গেজ লাইন নির্মাণ করা হলেও আড়ালে রাখা হয় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথকে।

অভিযোগ রয়েছে, রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং পরিবহণ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এ রেলপথকে অবহেলিত করে রাখা হয়। সড়ক পথের পরিবহণ কর্মকর্তাদের সঙ্গে অবৈধ লেনদেন ছিল সংশ্লিষ্ট রেলওয়ে কর্মকর্তাদের। লাইনের দুপাশে ৬২ ফুট অধিগ্রহণকৃত জমি থাকলেও নতুন লাইন স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ক্ষোভ প্রকাশ করে রেলওয়ের সাবেক এক মহাপরিচালক (ডিজি) জানান, স্বাধীনতার পর সরকারগুলোও রেল উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখেনি। বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর বহু রেলপথ, স্টেশন বন্ধ করে দিয়েছে। গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে ১৫ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ছাঁটাই করা হয়েছিল।

ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথ ছিল রেলের স্বর্ণযুগ উল্লেখ করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ে অপারেশন বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা পর্যন্ত রেলপথ ছিল অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক অন্যতম পথ। নারায়ণগঞ্জ স্টেশন থেকে স্টিমারে গোয়ালন্দ ঘাট পৌঁছে গোয়ালন্দ-শিলাইদহ রেলপথে কলকাতা পৌঁছানো যেত। নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর তীর পর্যন্ত অনেক ঘাটে রেললাইন ছিল। আদমজী রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল, কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট ও গেণ্ডারিয়া থেকে বুড়িগঙ্গা নদীর ঘাট পর্যন্ত রেললাইন ছিল। আর বাহাদুরাবাদ ঘাটের সঙ্গে যমুনা নদীর ওপারে রেলফেরির মাধ্যমে তিস্তামুখ ঘাট পর্যন্ত সংযুক্ত ছিল সান্তাহার-কাউনিয়া রেললাইন দ্বারা। সব ঘাটের অন্যতম ছিল নারায়ণগঞ্জ ঘাট। ঢাকায় মালামাল আসতে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা পর্যন্ত রেলপথ ছিল আশীর্বাদ। নারায়ণগঞ্জ-বাহাদুরাবাদ ঘাট লাইন শাখা রেললাইনের মাধ্যমে সারা দেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা সচল রেখেছিল।

এ বিষয়ে অতিরিক্ত রেলওয়ে মহাপরিচালক (অবকাঠামো) কামরুল আহসান যুগান্তরকে জানান, রেলপথ ছিল অবহেলিত। রেললাইন ও স্টেশন বন্ধ করা থেকে শুরু করে অবৈধভাবে কর্মীও ছাঁটাই করা হয়েছিল। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর রেল উন্নয়নে আমূল পরিবর্তন এসেছে। প্রায় ১০০ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প শেষ হয়েছে। পৌনে ২০০ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ডুয়েল গেজ ও ডাবল লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্প শেষ হলে এ পথে প্রতিদিন প্রায় ৯০ জোড়া ট্রেন চালানো সম্ভব হবে। অত্যাধুনিকভাবে নির্মাণ করা হচ্ছে রেলপথ ও স্টেশনগুলো। এ পথে ১২০ থেকে ১৩০ কিলোমিটার গতি নিয়ে ট্রেন চালানো যাবে।

সূত্র:যুগান্তর, ০১ জানুয়ারি ২০২২


About the Author

RailNewsBD
রেল নিউজ বিডি (Rail News BD) বাংলাদেশের রেলের উপর একটি তথ্য ও সংবাদ ভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল।

Comments are closed.