শিরোনাম

১০ ইঞ্জিন কেনার অনিয়ম তদন্তে নেমেছে দুদক

১০ ইঞ্জিন কেনার অনিয়ম তদন্তে নেমেছে দুদক

ইসমাইলআলীগত বছর দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম থেকে ১০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন কেনে রেলওয়ে। তবে ইঞ্জিনগুলোয় দরপত্রের শর্তানুসারে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ সংযোজন করেনি কোম্পানিটি। এতে ইঞ্জিনগুলোর মূল্য পরিশোধ প্রায় ১০ মাস ধরে ঝুলে আছে। এ নিয়ে শেয়ার বিজে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইঞ্জিনগুলোর অনিয়মের বিষয়ে তদন্তে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

সম্প্রতি রেলপথ মন্ত্রণালয়ে এ-সংক্রান্ত চিঠি পাঠায় দুদক। এতে চুক্তি লঙ্ঘন করে ইঞ্জিনে বিভিন্ন নিম্নমানের যন্ত্রাংশ সংযোজনের তথ্য চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি এক্ষেত্রে দায়ী কারা, সে বিষয়েও জানতে চাওয়া হয়েছে।

সূত্রমতে, দুদকের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে রেলওয়েকে চিঠি দিয়েছে মন্ত্রণালয়। এতে দুদকের উল্লিখিত প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়া হয়। পরে সে চিঠি প্রকল্প পরিচালকের কাছে পাঠান রেলওয়ের মহাপরিচালক। যদিও দুদকের চিঠির উত্তরে অনিয়মের চিত্র গোপনের চেষ্টা করছেন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মোহাম্মদ হাসান মনসুর। প্রকল্পটিতে কোনো ধরনের দুর্নীতি বা অনিয়ম হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মোহাম্মদ হাসান মনসুর শেয়ার বিজকে বলেন, ১০ ইঞ্জিনে শুধু অলটারনেটর চুক্তির বাইরে সংযোজন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে টিএ-১২-এর জায়গায় টিএ-৯ মডেলের অলটারনেটর দিয়েছে কোম্পানিটি। তবে টিএ-৯ মডেলের অলটারনেটর সংযোজন করলেও ইঞ্জিনে কোনো সমস্যা হবে না, বরং এটিই ইঞ্জিনের জন্য বেশি উপযোগী। আর নতুন কেনা ইঞ্জিনগুলো অনায়াসে ৩০ বছর সেবা দিতে পারবে।

যদিও তার দাবি সঠিক নয় বলে মনে করছেন রেলওয়ের অন্য প্রকৌশলীরা। তারা বলেন, যদি কোনো সমস্যা না থাকত তাহলে কেন চুক্তির বাইরে ভিন্ন মডেলের অলটারনেটর সংযোজন করা হলো? আর অলটারনেটর ছাড়াও মূল ইঞ্জিন চুক্তির বাইরে ভিন্ন মডেলের দেয়া হয়েছে। এছাড়া কম্প্রেসার ও ট্রাকশন মোটরও চুক্তি অনুযায়ী দেয়নি কোম্পানিটি। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তদন্তেও তা উঠে এসেছে, কিন্তু পিডি তা গোপন করতে চাচ্ছেন।

সূত্রমতে, ১০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন (লোকোমোটিভ) কেনায় দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেমের সঙ্গে ২০১৮ সালের ১৭ মে চুক্তি করে রেলওয়ে। চুক্তিমূল্য ছিল তিন কোটি ৭৯ লাখ ৬৩ হাজার ৪০০ ডলার বা প্রায় ৩১৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ অর্থ অগ্রিম দেয়া হয়। বাকি অর্থের মধ্যে ইঞ্জিনগুলো দেশে আসার পর ৬৫ শতাংশ বা ২০৭ কোটি টাকা পরিশোধের কথা। গুণগত মান যাচাই শেষে বাকি ১০ শতাংশ অর্থ পরিশোধের শর্ত ছিল।

যদিও নিন্মমানের ইঞ্জিন সরবরাহের কারণে চুক্তিমূল্যের ৬৫ শতাংশ অর্থ আটকে দেন তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক নূর আহম্মদ হোসেন। নিন্মমানের ইঞ্জিন গ্রহণে অস্বীকৃতিও জানান তিনি। পাশাপাশি এডিবিকেও জানানো হয় বিষয়টি। এর পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠন করে রেলপথ মন্ত্রণালয়। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়। এতে হুন্দাই রোটেম ও প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেক্টর সিঙ্গাপুরের সিসিআইসিকে অভিযুক্ত করা হয়।

তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ইঞ্জিনগুলোয় কারিগরি শর্ত অনুসরণ করা হয়নি। ইঞ্জিন, অলটারনেটর, কম্প্রেসার ও ট্রাকশন মোটর এ চারটি ক্যাপিটাল কম্পোনেন্টস চুক্তি অনুযায়ী সরবরাহ করা হয়নি। ফলে টেস্ট রানের সময় ইঞ্জিনের ব্রেক হর্সপাওয়ার ২২০০বিপিএইচ ও ট্রাকশন হর্সপাওয়ার ২০০০টিএইচপি হওয়ার কথা থাকলেও পাওয়া যায় যথাক্রমে ২১৭০বিপিএইচ ও ১৯৪২টিএইচপি।

রেলপথ সচিবের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হলেও অজ্ঞাত কারণে প্রায় চার মাস ধরে তা গোপন করে রাখা হয়েছে। আর হুন্দাই রোটেম বা সিসিআইসি কারও বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তবে শেয়ার বিজসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ১০ ইঞ্জিনের অনিয়মের বিষয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইঞ্জিনগুলোর জন্য বরাদ্দকৃত ঋণ ছাড় আটকে দিয়েছে এডিবি। এক্ষেত্রে আগে ইঞ্জিনের ক্ষেত্রে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনের শর্ত দেয়া হয়।

এদিকে এডিবির ঋণ চুক্তির মেয়াদ আগামী ৩০ জুন শেষ হওয়ার কথা। পাশাপাশি প্রকল্পটির মেয়াদও শেষ হওয়ার কথা ছিল আগামী ৩০ জুন। তাই ১০ ইঞ্জিন কেনা প্রকল্পের মেয়াদ ও এডিবির ঋণের মেয়াদ এক বছর বৃদ্ধির জন্য আবেদন করা হয়েছে।

এ বিষয়ে মোহাম্মদ হাসান মনসুর শেয়ার বিজকে বলেন, ১০ ইঞ্জিনের সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে চিঠি দিয়েছে এডিবি, যদিও জটিলতা নিরসনে কোনো পক্ষই সহায়তা করছে না। রেলওয়ে ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে চুপ রয়েছে। তাই বাধ্য হয়েই প্রকল্পের মেয়াদ ও এডিবির ঋণচুক্তির মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো হচ্ছে।

বিষয়টি নিয়ে জানতে রেলপথ সচিব মো. সেলিম রেজার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কল রিসিভ করেননি। পরে এসএমএস দেয়া হলে এবং একাধিকবার কল করলেও তিনি উত্তর দেননি। এমনকি রেলভবনে তার বক্তব্য নিতে সরাসরি যোগাযোগ করলেও তিনি দেখা করতে সম্মত হননি।

বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক ডিএন মজুমদারের কাছে এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, হুন্দাই রোটেমের সরবরাহকৃত ১০ ইঞ্জিন চালানোর উপযুক্ত কি না, তা যাচাই করে দেখতে কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি কাজ করছে, তবে এখনও কোনো প্রতিবেদন দেয়নি। ওই কমিটি ইঞ্জিনগুলোর বিষয়ে যে মতামত দেবে, সে অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

প্রসঙ্গত, গত ৯ ডিসেম্বর প্রথম ‘রেলওয়ের ১০ ইঞ্জিন কেনায় অনিয়ম: নিন্মমানের ইঞ্জিন সরবরাহ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় শেয়ার বিজে। পরে ১৮ জানুয়ারি ‘রেলের নিম্নমানের ১০ ইঞ্জিন কেনা: প্রশ্নবিদ্ধ তদন্ত কমিটি, হুন্দাই রোটেমের অসহযোগিতা’ শীর্ষক আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এছাড়া ৬ মার্চ ‘রেলওয়েকে নিন্মমানের ১০টি ইঞ্জিন সরবরাহ: দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ’ শীর্ষক তৃতীয় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। আর ২ এপ্রিল শেয়ার বিজে প্রকাশিত হয় ‘রেলওয়েকে নিম্নমানের ১০টি ইঞ্জিন সরবরাহ শাস্তি হয়নি কোরিয়ার হুন্দাই রোটেমের, পিডিকে বদলি’।

এদিকে করোনায় সাধারণ ছুটি চলাকালে ঈদুল ফিতরের আগে গোপনে ইঞ্জিনের চুক্তিমূল্যের ৬৫ শতাংশ পরিশোধের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৮ মে শেয়ার বিজে প্রকাশিত হয় ‘হুন্দাইয়ের নিন্মমানের ১০টি ইঞ্জিন: লকডাউনের মধ্যেই গোপনে মূল্য পরিশোধের পাঁয়তারা!’। এ প্রতিবেদন প্রকাশের পর মূল্য পরিশোধ প্রক্রিয়াটি বন্ধ হয়ে যায়, যা নিয়ে গত ২০ মে ‘হুন্দাইয়ের নিন্মমানের ১০টি ইঞ্জিন: আটকে গেল চুক্তির ৬৫% অর্থ পরিশোধ প্রক্রিয়া’ শীর্ষক আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। আর ২৫ মে প্রকাশিত হয় ‘সরবরাহকারী কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম: নিম্নমানের ১০ ইঞ্জিনে ঋণ ছাড় বন্ধ করে দিয়েছে এডিবি’।

সূত্র:শেয়ার বিজ, জুন ১৯, ২০২১


About the Author

RailNewsBD
রেল নিউজ বিডি (Rail News BD) বাংলাদেশের রেলের উপর একটি তথ্য ও সংবাদ ভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল।

Comments are closed.