শিরোনাম

রাজধানীর গেন্ডারিয়া রেলস্টেশনে রেলের জরাজীর্ণ আর নেই


।। নিউজ ডেস্ক ।।
রাজধানীর গেন্ডারিয়া রেলওয়ে স্টেশনে গেলে অবাক হয়ে দেখবেন সেই পুরোনো, জরাজীর্ণ ভবনটি আর নেই। তার জায়গায় গড়ে উঠছে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত নতুন ভবন।

বাংলাদেশ রেলওয়ের সাবেক মহাপরিচালক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘এটি পণ্য ও যাত্রী উভয়ের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্টেশন ছিল। নৌপথে বিভিন্ন জায়গা থেকে পণ্য আসত ঢাকার পোস্তগোলা সাইডিংয়ে। সেখানে পণ্যগুলো লোড-আনলোড করা হতো। তারপর সেগুলো নিয়ে আসা হতো গেন্ডারিয়ায়। ‘গেন্ডারিয়া থেকে এসব পণ্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হতো।’

তোফাজ্জল হোসেন আরও জানান, বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে গেন্ডারিয়া রেলস্টেশন থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ সাইডিং লাইন (মালবাহী ট্রেনের জন্য আলাদা লাইন) ছিল। তবে কর্মব্যস্ত বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলো (তেজগাঁও ও গেন্ডারিয়া) ১৯৭১ সালের পর জৌলুশ হারিয়ে ফেলে। সড়ক পরিবহন আরও উন্নত হওয়ায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের পণ্য পরিবহনও কমে যায়।

সরকার এখন গেন্ডারিয়া রেলস্টেশনকে দ্বিতল জংশন স্টেশনে পরিণত করার কাজ করছে। এ স্টেশন পদ্মা সেতুর মাধ্যমে ঢাকা-যশোর রেললাইনকে সংযুক্ত করবে এবং আরেকটি রেললাইন নারায়ণগঞ্জের সঙ্গে যুক্ত হবে।

সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
ঢাকায় প্রথম রেললাইন স্থাপিত হয় নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা পর্যন্ত। নির্মাণ কাজ প্রথমে নারায়ণগঞ্জে শুরু হয় এবং পর্যায়ক্রমে ঢাকায় এসে শেষ হয়। আগে কলকাতার শিয়ালদহ থেকে ট্রেন আসত গোয়ালন্দ ঘাটে। ঢাকায় আসার জন্য মানুষ প্রথমে গোয়ালন্দ থেকে স্টিমারে করে নারায়ণগঞ্জে আসত। তারপর সেখান থেকে ফের ট্রেনে করে ঢাকায়। গেন্ডারিয়া রেলস্টেশনের ইতিহাস দারুণ সমৃদ্ধ।

বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী পাটজাত পণ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদার ফলে ঢাকা ও ময়মনসিংহ থেকে কলকাতা বন্দরে পাট সরবরাহের জন্য উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রয়োজন দেখা দেয়।

এর ফলে ১৮৮৫ সালে ময়মনসিংহ থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত ১৪৪ কিলোমিটার দীর্ঘ মিটারগেজ রেললাইন স্থাপিত হয়, যা ঢাকা স্টেট রেলওয়ে নামে পরিচিতি পায়। এ রেলপথটি নির্মিত হয় মূলত নদী দিয়ে কাঁচা পাট নারায়ণগঞ্জ থেকে কলকাতায় নেওয়ার জন্য। ওই সময় এ লাইনের অংশ হিসেবে নির্মিত হয়েছিল গেন্ডারিয়া রেলস্টেশন।

অচিরেই গেন্ডারিয়া ঢাকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রেলস্টেশনে পরিণত হয়। ১৮৮৫ সালের পর ঢাকায় আদতে দুটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিল। এর মধ্যে একটি ছিল তেজগাঁও রেলস্টেশন, অপরটি গেন্ডারিয়া রেলস্টেশন।

ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুন বলেন, মূল স্টেশনটি যখন নির্মাণ করা হয়, তখন গেন্ডারিয়া ছিল শহরতলী। গুটিকয়েক লোক বাস করত এ এলাকায়।

ট্রেনের যাত্রীরা ছিল মূলত উচ্চবিত্ত, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও ছাত্র। কলকাতায় যাওয়ার জন্যও তারা এই পথ ব্যবহার করত। ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ থেকে গোয়ালন্দ ঘাট এবং তারপর স্টিমারে করে কলকাতা যেত তারা।

এছাড়া ২০০০ সালের আগেও চালু ছিল পোস্তগোলা সাইডিং। জায়গাটি এখন মানুষের দখলে। রেলওয়ে নিজেই জনবল, লোকোমোটিভ ও ওয়াগনের অভাবে ভুগছে। ফলে রেলসেবা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে মানুষ।

নতুন পরিবর্তন
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (ওয়ার্কস অ্যান্ড ট্র্যাক) আবু ইউসুফ মোহাম্মদ শামীম বলেন, আগে স্টেশনটিতে দুটি মিটারগেজ রেললাইন ছিল। ফলে শুধু ছোট আকারের মিটারগেজ ট্রেন চলাচল করতে পারত।

নতুন প্রকল্পের আওতায় সরকার চারটি রেললাইন স্থাপন করেছে। চারটিই ডুয়েল গেজ, অর্থাৎ ওয়াইড ব্রড-গেজে রূপান্তরিত করা হবে। সেইসঙ্গে ছোট আকারের মিটারগেজ ট্রেনও এ লাইনে চলতে পারবে। আগে এ স্টেশনে একটি প্ল্যাটফর্ম ছিল, এখন দুটি নির্মাণ করা হচ্ছে।

একটি প্ল্যাটফর্ম রেলওয়ে স্টেশন বিল্ডিংয়ের সঙ্গে তৈরি করা হবে, অপরটি নির্মাণ করা হবে আইল্যান্ড প্ল্যাটফর্ম হিসেবে। এর ফলে প্ল্যাটফর্মের উভয়পাশে ট্রেন থামতে পারবে।

আবু ইউসুফ বলেন, ‘দুটি রেললাইন ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে ডেডিকেটেড থাকবে, বাকি দুটি ঢাকা-যশোর রুটে ডেডিকেটেড থাকবে।’

তবে রেললাইনটি ডুয়েল গেজ হওয়ায় যেকোনো ট্রেন যেকোনো গন্তব্যে যেতে পারবে বলে জানান তিনি। তাছাড়া ওই এলাকায় পর্যাপ্ত জমি না থাকায় সরকার দোতলা স্টেশন নির্মাণ করছে।

পুরোনো স্টেশনে ওয়েটিং রুম না থাকলেও নতুন স্টেশনে যাত্রীদের বসার ব্যবস্থা থাকবে। শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থাও করা হবে।

দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষকে ভবিষ্যতে বিশ্রামাগার করা হবে। একটি ভিআইপি ওয়েটিং রুমও থাকবে স্টেশনে।

রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনের মতো যাত্রীর চাপ বাড়লে গেন্ডারিয়া স্টেশনেও আন্তঃনগর ট্রেন থামতে পারে।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, এই আধুনিক সময়েও রেললাইন উঁচু না করে নিচু স্তরে নির্মাণ করা হয়েছে। তাই যানবাহনকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রেলক্রসিংয়ে অপেক্ষা করতে হয়। নতুন রেলস্টেশনটি ৫০০ থেকে ৫৫০ বর্গমিটার জমির ওপর নির্মিত হয়েছে, যা অতীতের জমির চারগুণ বেশি।

রেলওয়ে কর্মকর্তা আবু ইউসুফ মোহাম্মদ শামীম বলেন, সাধারণত রেলওয়ে জংশন স্টেশনগুলো একটু বেশি গুরুত্ব পায়। আর গেন্ডারিয়া রেলস্টেশন আগের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে, কারণ এখন স্টেশনটি থেকে যাত্রীরা বিভিন্ন গন্তব্যে যেতে পারবে।

স্টেশনটি দয়াগঞ্জের প্রধান সড়কের পাশে অবস্থিত। ট্রেনের নিরাপত্তার জন্য স্টেশনটিকে ইটের সীমানাপ্রাচীর দিয়ে ঘিরে দেওয়া হবে। মানুষ যেহেতু সরাসরি এই সড়কে যেতে পারবে না, সেজন্য তাদের সুবিধার্থে স্টেশনের পাশে একটি আন্ডারপাস তৈরি করা হয়েছে।

নারায়ণগঞ্জকে সংযোগকারী দুটি রেললাইন প্রায় প্রস্তুত হওয়ায় যেকোনো সময় খুলে দেওয়া হবে। বাকি লাইনগুলো নির্মাণাধীন। কর্তৃপক্ষকে ২০২৪ সালের এপ্রিলের মধ্যে নির্মাণ সম্পন্ন করতে হবে।

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর হতে ঢাকা (কমলাপুর রেলস্টেশন) থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত যাত্রীবাহী ট্রেন পরিচালনার পরিকল্পনা করছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। কর্মকর্তারা জানান, যাত্রীর চাহিদা থাকলে একই মাসে ট্রেনটি গেন্ডারিয়াতেও থামতে পারে। তবে আগামী বছরের জানুয়ারির মধ্যে স্টেশনটির সম্পূর্ণ নির্মাণকাজ শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।

অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, আগে ঢাকা শহরে ট্রেনে প্রবেশের একটি মাত্র গেটওয়ে ছিল। সবগুলো ট্রেন আসত উত্তর দিক দিয়ে। তিনি বলেন, প্রতিদিন নারায়ণগঞ্জ ও আশপাশের এলাকা থেকে প্রচুর মানুষ ঢাকায় আসে। তাদের অনেকেই গেন্ডারিয়া রেলস্টেশনে থামে। তাই নতুন স্টেশনটি তাদেরকে কিছুটা স্বস্তি দেবে।

গেন্ডারিয়া স্টেশন পুনর্নির্মাণের কারণ
যাত্রীদের উন্নত সুযোগ-সুবিধা দিতে স্টেশনটি নির্মাণ করা হচ্ছে। গেন্ডারিয়া স্টেশন আগের মতো গুরুত্বপূর্ণ না হলেও যাত্রীসংখ্যা এখনও অনেক। এছাড়া রেলওয়ে কর্মকর্তারা বলেন, সবসময় স্রেফ যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের জন্যই একটি স্টেশন তৈরি করা হয় না। ট্রেনের ঝামেলাবিহীন, মসৃণ নিয়ন্ত্রণ ও চলাচল নিশ্চিত করার জন্যও স্টেশন তৈরি করা হয়।

সূত্রঃ দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ড


About the Author

RailNewsBD
রেল নিউজ বিডি (Rail News BD) বাংলাদেশের রেলের উপর একটি তথ্য ও সংবাদ ভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল।

Comments are closed.