শিরোনাম

ফেনীতে গত চার মাসে ট্রেনে কাটা পরে মৃত্যু আটজনের


।। নিউজ ডেস্ক ।।
অরক্ষিত রেলক্রসিং আর অসচেতনতায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় জীবন হারাচ্ছে অনেক মানুষ। তেমনি ফেনীতেও গত চার মাসে ট্রেনে কাটা পরেছে আটজন। সেই সাথে এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও অন্তত ১০ জন। মৃত ও আহতদের মধ্যে কেউ সেলফি তুলতে, কেউ মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে রেললাইনের উপর দিয়ে হাটতে , কেউ আবার কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে। অনেক সময় বিভিন্ন যানবাহনের চালক ও পথচারীরা দ্রুত রেললাইন পার হওয়ার চেষ্টা করেও দুর্ঘটনার শিকার হন।

বৃহস্পতিবার (১ ফেব্রুয়ারি) রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের ফেনী রেলস্টেশনের কাছে সহদেবপুর রেলক্রসিং এলাকায় রেললাইন পারাপারের সময় ট্রেনের ধাক্কায় এক নারী দলিল লেখক নিহত হয়েছেন। নিহত নারীর নাম স্বপ্না রানী দেবী (৪২)। তিনি ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার রামনগর ইউনিয়নের সেকান্দরপুর গ্রামের পরিমল চন্দ্র ভৌমিকের স্ত্রী।

গত চার মাসে (অক্টোবর থেকে জানুয়ারি) রেলপথের ফেনী অংশে ট্রেনে কাটা পড়ে আটজনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের মধ্যে চারজন অজ্ঞাত। যাদের পরিচয় পাওয়া গেছে তার হলেন- ফরিদা ইয়সমিন (৩৩), মো. রুবেল (৪৫), মো. শরীফ (২৭), ও শহীদুল ইসলাম (২৫) মারা যান। এছাড়া ২০২২ সালের ১১ অক্টোবর ভোরের দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফতেহপুর রেলক্রসিংয়ে যাত্রীবাহী বাস রেললাইনে উঠে পড়লে ট্রেনের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটে। এতে চারজন প্রাণ হারান।

ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের ফেনী অংশে শশর্দী থেকে মুহুরীগঞ্জ পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ২৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে অনুমোদনহীন অরক্ষিত ১২টি ও ২২টি অনুমোদিত রেলক্রসিং রয়েছে।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী (পথ) রিটন চাকমা ইউএনবিকে বলেন, “প্রতিনিয়ত ইচ্ছেমত রেলের ওপর দিয়ে পথ তৈরি করা হচ্ছে। অনুমোদনহীন এসব ক্রসিংগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে মুহুরীগঞ্জে। এখানে ছয়টি অনুমোদনহীন রেলক্রসিং তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া শর্শদী, দেওয়ানগঞ্জ, ফাজিলপুরে রয়েছে আরও ছয়টি। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে মুহুরীগঞ্জ। অনুমোদনহীন অরক্ষিত রেলক্রসিং বন্ধ করা হলেও মানুষ নতুন করে পথ তৈরি করে থাকে।”

ফেনীর বারাহীপুর রেলক্রসিং এলাকার দায়িত্বে থাকা গেটম্যান জীবন বলেন, “ট্রেন আসার আগেই গেট বন্ধ করা হয়। কিন্তু গাড়ির চালক ও পথচারীরা দ্রুত রেললাইন পার হওয়ার চেষ্টা করে থাকেন। এতে অনেক সময় দুর্ঘটনার শিকার হন তারা। এক পাশের গেট ফেলে অন্য পাশে যেতে না যেতেই লোকজন সেই গেট তুলে পার হয়ে যান। নিষেধ করলেও শোনেন না। অনেক সময় তাদের মারতেও তেড়ে যাই। আর দুর্ঘটনা ঘটলে দোষ হয় গেটম্যানদের।”

অনুমোদনহীন এসব রেলক্রসিং প্রসঙ্গে ফেনী রেলস্টেশন মাস্টার মো. হারুন বলেন, “রেলপথের পাশে বসতঘর থাকায় বিভিন্ন সময় অনুমোদনহীন ক্রসিং তৈরি করা হয়। ফলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা অনেক বেশি বাড়ছে।”

রেলওয়ে পুলিশের ফেনী ফাঁড়ির উপ-পরিদর্শক (এসআই) জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “গত চার মাসে রেলপথের ফেনী অংশে ট্রেনে কাটা পড়ে আটজনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন। বিভিন্ন সময়ে দুর্ঘটনায় আটটি অপমৃত্যুর মামলাসহ ১০টি মামলা রেকর্ড হয়েছে। এছাড়া বারাহীপুর রেলক্রসিং, শহরের রেলগেট ক্রসিংয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে এবং প্রাণহানিও হয়।”

বিভিন্ন পেশার মানুষরা মনে করেন, অনুমোদনহীন রেলক্রসিং ছাড়াও আরও কিছু অসামঞ্জস্য, বিকল প্রযুক্তি রেলপথকে আরও দুর্ঘটনাপ্রবণ করে তুলছে। বিকল সিগন্যাল বাতি, অনুমোদিত রেলক্রসিংগুলোতে গেটকিপারদের দায়িত্বে অবহেলা, পথচারী ও যানবাহন চালকদের অসচেতনতা, আগে দুর্ঘটনার যথাযথ তদন্ত প্রকাশ্যে না আসা, সব স্থানে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা না থাকা ইত্যাদি কারণ দুর্ঘটনার প্রবণতা বাড়াচ্ছে।

ফেনী শহরের ব্যস্ততম পুরাতন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গুদাম কোয়ার্টারে রেলক্রসিংকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দা মাহমুদুল হক। তিনি বলেন, “ট্রেন আসার আগে ক্রসিংয়ে গেট ফেলেও যানবাহন চালকদের আটকে রাখা যায় না। স্বয়ংক্রিয় সাইরেনের শব্দ পথচারীদের কানে আলোড়ন তুললেও চালকদের তাতে কোনো ভ্রুপেক্ষ নেই। এ ক্রসিংয়ে বহুবার ঘটেছে হতাহতের ঘটনা।”

রেলওয়ে বিভাগের তথ্যমতে, ফেনীর প্রায় ২৭ কিলোমিটার অংশে মোট ৩৪টি রেলক্রসিং রয়েছে। এরমধ্যে ২২টি বৈধ লেভেলক্রসিংয়ের গেটম্যান ৬৬ জনের মধ্যে রয়েছেন ৫৬ জন। অন্যদিকে ১২টি অবৈধ ক্রসিংয়ের কিছুই নেই। আছে শুধু রেল কর্তৃপক্ষের একটি সতর্কীকরণ লেখা। সাময়িক বন্ধ করা হয়েছে এসব ক্রসিং। অরক্ষিত অবৈধ ক্রসিংয়ের কারণেই প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা।

এসব ক্রসিং নিরাপদ করতে পর্যায়ক্রমে পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ফেনী রেলওয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলী রিতন চাকমা বলেন, “অননুমোদিত লেভেলক্রসিংয়ে নিজ নিজ দায়িত্বে চলাচল করা উচিৎ। কেননা অননুমোদিত হওয়ায় এসব ক্রসিংয়ে কোনো গেটম্যান নেই। এসব ক্রসিং নিরাপদ করতে পর্যায়ক্রমে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) ফেনী জেলার সাধারণ সম্পাদক মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, “তিন কারণে রেলের লেভেলক্রসিংয়ে ঘটছে দুর্ঘটনা। অবৈধভাবে রেল কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে বা সমন্বয় না করে যেসব রাস্তা বানানো হয়েছে, সেসব লেভেলক্রসিংয়ের বেশির ভাগই অরক্ষিত। গেটম্যান না থাকায় অনেক বৈধ লেভেলক্রসিংও সুরক্ষিত নয়। আবার রেলের লেভেলক্রসিং পারাপারে অনেক সময় সচেতনতার পরিচয় দেন না চালক-পথচারীরা। এছাড়া গেটম্যানদের অবহেলা তো রয়েছেই। ফলে থামছে না দুর্ঘটনা, দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল।”


About the Author

RailNewsBD
রেল নিউজ বিডি (Rail News BD) বাংলাদেশের রেলের উপর একটি তথ্য ও সংবাদ ভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল।