শিরোনাম

ট্রেনের লাইনচ্যুতি

খারাপ রেল অবকাঠামোয় এশিয়ার পাঁচ দেশের অন্যতম বাংলাদেশ

শামীম রাহমান : তিন হাজার কিলোমিটারের রেল নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের। পুরনো রেলপথ আর রেলসেতুতে ট্রেনের লাইনচ্যুতি বাংলাদেশ রেলওয়ের নিত্য ঘটনা। সিগন্যাল ব্যবস্থা যেমন দুর্বল, তেমনি দুর্বল স্টেশনের অবকাঠামো। বুড়িয়ে গিয়েছে সিংহভাগ ইঞ্জিন। নতুন নতুন কোচ এলেও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেগুলো দ্রুত চলে যাচ্ছে ভঙ্গুর দশায়। সময় মেনে না চলা, টিকিট পেতে হয়রানি, কর্মীদের অদক্ষতার মতো বিষয়গুলো নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে যাত্রীসেবার মানে। পণ্য পরিবহন ব্যবস্থাও দুর্বল। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের রেল অবকাঠামোর মান রয়ে গিয়েছে বৈশ্বিক সূচকের তলানিতে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) তথ্য বলছে, এশিয়ায় খারাপ রেল অকাঠামো রয়েছে এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। কোন দেশের রেল অবকাঠামো কেমন, সূচক আকারে তা নিয়মিত প্রকাশ করে আসছে ডব্লিউইএফ। সূচকটি তৈরিতে রেল যোগাযোগ রয়েছে এমন দেশগুলোকে ১ থেকে ৭-এর মধ্যে ‘স্কোরিং’ করেছে সংস্থাটি। রেল অবকাঠামো সবচেয়ে অনুন্নত হলে ১ আর সবচেয়ে ভালো হলে ৭ পর্যন্ত স্কোর দেয়া হয়েছে। ২০১৯ সালে এ সূচকে বাংলাদেশের রেল অবকাঠামোর স্কোর ৩ দশমিক ১। আর ১০১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৬১ নম্বরে। এশিয়া মহাদেশে বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ রেলপথ রয়েছে আর মাত্র তিনটি দেশে। থাইল্যান্ডের অবস্থান সূচকের ৭৫ নম্বরে। জর্ডান ও ফিলিপাইন রয়েছে যথাক্রমে ৮০ ও ৮৬ নম্বরে। অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বাংলাদেশের। ডব্লিউটিএফের ‘কোয়ালিটি অব রেলরোড ইনফ্রাস্ট্রাকচার’ সূচকে ভারতের অবস্থান ২৮তম। ৪৭ ও ৪৮ নম্বরে রয়েছে যথাক্রমে পাকিস্তান ও শ্রীলংকা। ডব্লিউটিএফের সূচক অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে ভালো রেল অবকাঠামো জাপানের। ৭-এর মধ্যে ৬ দশমিক ৮ স্কোর পেয়েছে দেশটির রেল অবকাঠামোর মান। হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর রয়েছে যথাক্রমে শীর্ষ পাঁচে। বিপরীতে সবচেয়ে খারাপ রেল অবকাঠামো উরুগুয়ের। এরপর যথাক্রমে রয়েছে আলবেনিয়া, ভেনিজুয়েলা, কলম্বিয়া ও বেনিন। উন্নত প্রযুক্তি আর অবকাঠামো, দ্রুতগতির ট্রেন, কঠোর সময়ানুবর্তিতার মতো বিষয়গুলোয় জোর দিয়ে উন্নত দেশগুলো যেখানে তাদের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার খোলনলচে বদলে দিচ্ছে, সেখানে এখনো পুরনো অবকাঠামোগুলোই ঠিকমতো ধরে রাখতে পারছে না বাংলাদেশ রেলওয়ে। সংস্কারের অভাবে দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে রেলপথ। জনবলের অভাবে বন্ধ থাকছে স্টেশন। যথাযথ পরিকল্পনা ছাড়াই নতুন নতুন ট্রেন নামিয়ে বাড়ানো হচ্ছে শিডিউল বিপর্যয়। রেলপথ, রোলিংস্টক, সিগন্যাল ব্যবস্থা, জনবল, ট্রেন পরিচালনা ব্যবস্থা, যাত্রীসেবায় বছরের পর বছর ধরে কেবল লোকসানই গুনে যাচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। স্বাধীনতার পর থেকেই রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ‘ধারাবাহিকভাবে অবহেলা’র কারণেই বাংলাদেশ রেলওয়ের এ বেহাল অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, শুরু থেকেই রেলের উন্নয়নে নীতিগত ভুল আমরা করেছি। খাতটিতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ তো করিইনি, উল্টো আমরা জনবল কমিয়েছি। স্টেশন বন্ধ করে দিয়েছি। রক্ষণাবেক্ষণ না করে রেল অবকাঠামো ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছি। বিগত কয়েক বছরে রেলওয়েতে বড় বড় বিনিয়োগ করা হচ্ছে। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের একটা বড় ঘাটতি আছে। কোন কাজটি আগে করতে হবে, কোনটি পরে হবে—তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা হচ্ছে না। বিনিয়োগ প্রকল্পের মাধ্যমে অবকাঠামো উন্নয়নের দিকেই সবার ঝোঁকটা বেশি। রেলওয়েতেও তাই হচ্ছে। আমাদের রেললাইন খারাপ, আমাদের লাইনে সক্ষমতার চেয়ে ট্রেন চলাচল বেশি, আমাদের পরিকল্পনা দুর্বল, আমাদের কোনো জবাবদিহি করতে হয় না, আমরা পেশাদার নই। সরকার ও রেলওয়ের উচিত সবার আগে এসব সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করা। তবে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, দীর্ঘদিন অবহেলিত থাকার পর গত এক দশক ধরে রেলপথের উন্নয়নে অনেক বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এসবের মাধ্যমে রেলওয়ের অবকাঠামো থেকে যাত্রীসেবার ধরন—সবকিছুই বদলে ফেলা হচ্ছে। এরই মধ্যে মানুষ এসবের সুফলও পেতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন তারা। ডব্লিউইএফের তথ্যেও উঠে এসেছে বাংলাদেশের রেল অবকাঠামোর ক্রমোন্নতির চিত্র। ২০১৩ সালে ২ দশমিক ৪৪ স্কোর পেয়ে ১০১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের রেল অবকাঠামো ছিল ৭৮তম অবস্থানে। সেখান থেকে ১৭ ধাপ এগিয়ে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ চলে এসেছে ৬১তম স্থানে। স্কোরে উন্নতি হয়েছে দশমিক ৬৬ শতাংশ। রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন মনে করছেন বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়েতে যেভাবে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে আরো ভালো হয়ে উঠবে অবকাঠামোর মান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, রেলকে আধুনিকায়নের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই কাজ করে যাচ্ছে। নতুন নতুন রেলপথ, রেলসেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। বন্ধ থাকা স্টেশন চালু করা হচ্ছে। নতুন কোচ-ইঞ্জিন কেনা হচ্ছে। সিগন্যালিং ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো হচ্ছে। জনবল বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিদ্যুচ্চালিত, হাইস্পিড ট্রেন চালুর জন্য আমরা কাজ করছি। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয় রেলপথ নির্মাণ, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণে যেসব প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, বাংলাদেশ রেলওয়েতেও সেগুলোর ব্যবহার শুরুর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। চলমান প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ রেলওয়ের অবকাঠামোর মান আরো উন্নতি হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন মন্ত্রী। সূত্র:বণিক বার্তা, জুলাই ১৭, ২০২১